এক:
কবরের আযাব নিয়ামত কুরআন-সুন্নাহর দলিল ও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। মূল বিধান হলো: কবরের আযাব ও নিয়ামত হবে আত্মার উপর। কখনো আত্মা শরীরের সাথে যুক্ত হয় বিধায় শরীরও কিছু শাস্তি অথবা নিয়ামত পেতে পারে।
পক্ষান্তরে কবরে কোনো হিসাব নেই। বরং কিছু আমলের কারণে শাস্তি কিংবা নেককার মানুষ হলে নিয়ামত রয়েছে। হিসাব হবে কিয়ামতের ময়দানে।
দুই:
মৌলিকভাবে সকল মানুষ কিয়ামতের ময়দানে জিজ্ঞাসিত হবে; কেবল একদল মানুষ ছাড়া যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করবেন। কোনো হিসাব ও শাস্তি ছাড়াই তিনি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। ইতঃপূর্বে (4203) নং প্রশ্নের উত্তরে যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে।
আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: যখন এই আয়াতটি অবতীর্ণ হলো: ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنْ النَّعِيمِ "অতঃপর অবশ্যই সেদিন তোমরা নিয়ামতের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে” তখন মানুষেরা বলতে লাগল: ‘আল্লাহর রাসূল! কোন নিয়ামত সম্পর্কে আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে? আমাদের কাছে তো দুটি কালো জিনিস (পানি ও খেজুর) আছে। আর দুশমন সর্বদা উপস্থিত এবং তরবারীগুলো আমাদের কাঁধের উপরেই আছে?’ তিনি বললেন: ‘এটি অচিরেই ঘটবে।’[সুনানে তিরমিযী (৩৩৫৭); শাইখ আলবানী সহিহুত তিরমিযীতে হাদিসটিকে হাসান বলেছেন]
ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ এই আয়াতের তাফসীরে বলেন: ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنْ النَّعِيمِ "অতঃপর তোমরা অবশ্যই তোমাদেরকে আল্লাহ যে সমস্ত নিয়ামত দিয়েছেন সেগুলোর কৃতজ্ঞতা করার ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।" এর মধ্যে রয়েছে: স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, রিযিক ইত্যাদি। অর্থাৎ তোমরা কি তার নিয়ামতসমূহের বিপরীতে শুকরিয়া ও তার ইবাদত করেছ।’[সমাপ্ত][তাফসীরে ইবনে কাসীর (৮/৪৭৪)]
তিরমিযী (২৪১৭) বর্ণনা করেন এবং বর্ণনাটিকে বিশুদ্ধ বলে গণ্য করেন: আবু বারযা আল-আসলামী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “কিয়ামতের দিন ততক্ষণ পর্যন্ত কোন বান্দার পা সরবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তাকে প্রশ্ন করা হয়: তার আয়ু কী কাজে ব্যয় করেছে, তার ইলম দ্বারা কী আমল করেছে, তার সম্পদ কোথা থেকে উপার্জন করেছে এবং কীভাবে ব্যয় করেছে, তার দেহকে কোন কাজে ক্ষয় করেছে?।”[শাইখ আলবানী সহীহুত তিরমিযী গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলে গণ্য করেন]
ইবনুল কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন: কাতাদাহ (রহঃ) বলেছেন: ‘আল্লাহ প্রত্যেক বান্দাকে প্রদত্ত নিয়ামত সম্পর্কে ও তার অধিকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।
যে নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে সেটি দুই প্রকার: এক প্রকার সে হালাল উৎস থেকে উপার্জন করেছে এবং যথাযথ খাতে ব্যয় করেছে। এই প্রকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। আরেক প্রকার সে হারাম উৎস থেকে উপার্জন করেছে এবং অবৈধ খাতে ব্যয় করেছে। এই প্রকারের উৎস ও ব্যয়ের খাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।[সমাপ্ত][ইগাসাতুল লাহফান: (১/৮৪)]
তিনি আরো বলেন: ‘প্রত্যেক ব্যক্তিকে দুনিয়াতে সে যে নিয়ামত ভোগ করেছে তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে: সে কি তা হালালভাবে উপার্জন করেছে; নাকি না? যখন সে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ছাড় পাবে, তখন তাকে আরেকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হবে সেটি হচ্ছে: সে কি এর দ্বারা আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নিজেকে আল্লাহর আনুগত্যে নিয়োজিত করেছিল; নাকি করেনি? প্রথম প্রশ্নটি হচ্ছে তার উপার্জনের মাধ্যম সম্পর্কে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে তার ব্যয়ের খাত সম্পর্কে।’[সমাপ্ত][উদ্দাতুস সাবিরীন (পৃ. ১৫৭)]
তিন:
কিয়ামতের দিন হিসাব দুই প্রকার:
প্রথম প্রকার:
পেশ করার হিসাব। এটি মুমিনের জন্য নির্দিষ্ট। তাকে তার আমল, তার ইলম ও আল্লাহ কর্তৃক তাকে প্রদত্ত নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। সে এমন জবাব দিবে যা তার বক্ষকে প্রশস্ত করে দিবে, তার প্রমাণকে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং তার উপর আল্লাহর নিয়ামতকে স্থায়ী করবে।
আবার তার সামনে তার গুনাহগুলো পেশ করা হলে সে এগুলোর স্বীকৃতি দিবে। এরপর আল্লাহ তার সেই গুনাহগুলো গোপন করে রাখবেন এবং তাকে ক্ষমা করে দিবেন।
এমন ব্যক্তির কাছ থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব নেওয়া হবে না, কড়াকড়ি করা হবে না ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না। সে ডান হাতে তার আমলনামা নিয়ে আনন্দচিত্তে পরিবারের কাছে ফিরে যাবে। কারণ সে শাস্তি থেকে বেঁচে গিয়েছে এবং নেকী লাভ করে সফলকাম হয়েছে।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তির পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব নেওয়া হবে সে শাস্তি পাবে।” আয়েশা বলেন: আমি বললাম: ‘আল্লাহ তাআলা না বলেছেন: فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَابًا يَسِيرًا “অচিরেই তার খুব সহজ হিসাব নেয়া হবে”? তিনি বললেন: “সেটা (সহজ হিসাব) হচ্ছে আমলনামার উপস্থাপন।”[বুখারী (6536) ও মুসলিম (2876)]
হাফেয ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘কুরতুবী বলেছেন: ‘সেটা হচ্ছে আমলনামার উপস্থাপন’ এই কথার অর্থ হচ্ছে: আয়াতে উল্লিখিত হিসাব হচ্ছে এই যে, মুমিনের আমলনামা তার সামনে উপস্থাপন করা হবে যাতে করে সে তার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ কতটুকু তা জানতে পারে; দুনিয়াতে তার গুনাহগুলো গোপন রাখার মাধ্যমে এবং আখিরাতে গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেয়ার মাধ্যমে।’[সমাপ্ত]
আয়েশা (রাঃ) বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সহজ হিসাব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল! সহজ হিসাব কী? তিনি বললেন: “ব্যক্তির সামনে তার পাপসমূহ পেশ করা হবে। তারপর সেগুলো মাফ করে দেয়া হবে। কেননা যার হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নেওয়া হবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে।”[মুসনাদে আহমদ (২৪৯৮৮)। শাইখ আলবানী ‘যিলালুল জান্নাহ’ গ্রন্থে (২/১২৮) এ হাদিসকে সহিহ বলেছেন]
শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘মুমিন ব্যক্তির হিসাব গ্রহণ করা হবে; কিন্তু সেটি পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব নয়। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব নেওয়া হবে সে ধ্বংস হবে (অথবা তিনি বলেছেন) সে শাস্তি পাবে।”[সমাপ্ত][আল-লিকাউশ শাহরী (১/৩৭৮)]
ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: আল্লাহ তাআলা মুমিনকে তার নিকটে এনে তার উপর পর্দা ফেলে তাকে ঢেকে দিবেন এবং বলবেন: ‘অমুক পাপের কথা মনে পড়ে, অমুক পাপের কথা মনে পড়ে?’ সে বলবে: ‘হ্যাঁ, হে আমার রব।’ এভাবে যখন তার সকল পাপের স্বীকারোক্তি নিবেন এবং সে মনে করবে যে সে ধ্বংস হয়ে গেল তখন আল্লাহ বলবেন: “আমি দুনিয়াতে তোমার এসব পাপ গোপন রেখেছি; আর আজ আমি তোমার সে সব পাপ ক্ষমা করে দিচ্ছি। অতঃপর তাকে তার নেক আমলের বই দেয়া হবে। পক্ষান্তরে, কাফের ও মুনাফিক সম্পর্কে সাক্ষীরা বলবে: এরা তাদের রবের ওপর মিথ্যারোপ করেছিল। জেনে নাও, অন্যায়কারীদের ওপর আল্লাহর লানত।”[সহিহ বুখারী (২৪৪১) ও সহিহ মুসলিম (২৭৬৮)]
দ্বিতীয় প্রকার:
পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব। এটি কাফেরদের ক্ষেত্রে আল্লাহর হিসাব এবং তাওহীদবাদী পাপীদের মধ্যে আল্লাহ যাদের ব্যাপারে চান তাদের ক্ষেত্রে গৃহীত হিসাব। এদের পাপের আধিক্যের কারণে হিসাব দীর্ঘ ও কঠিন হবে। এই সমস্ত তাওহীদবাদী পাপীদের মাঝে যাদেরকে ইচ্ছা আল্লাহ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন, তারপর তাদেরকে বের করে এনে স্থায়ীভাবে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: “সাহাবীরা বলল: “হে আল্লাহর রাসূল! কিয়ামতের দিন আমরা কি আমাদের রবকে দেখব?” তিনি বললেন: “তোমরা কি ভর দুপুরে মেঘমুক্ত আকাশে সূর্য দেখার জন্য ধাক্কাধাক্কি করে কষ্ট পাও?” তারা বলল: ‘না।’ তিনি বললেন: “তোমরা কি পূর্ণিমার রাতে মেঘহীন আকাশে চাঁদ দেখার জন্য ধাক্কাধাক্কি করে কষ্ট পাও?” তারা বলল: ‘না।’ তিনি বললেন: “ঐ সত্ত্বার কসম যার হাতে রয়েছে আমার আত্মা, তোমরা তোমাদের রবকে দেখায় কোন কষ্ট পাবে না, যেমন তোমরা কষ্ট পাও না সূর্য-চাঁদ কোনো একটি দেখার ক্ষেত্রে।” তিনি বলেন: “আল্লাহ বান্দার সাথে সাক্ষাত করবেন অতঃপর বলবেন: ‘হে অমুক! আমি কি তোমাকে সম্মানিত করিনি, তোমাকে নেতৃত্ব দেইনি, তোমাকে বিয়ে করাইনি এবং তোমার জন্য ঘোড়া ও উটকে অনুগত করে দেইনি, তোমাকে গোত্রপ্রধান বানাইনি ও গোত্রপ্রধানের গনীমতের ভাগ (এক চতুর্থাংশ) নিতে দেইনি?’ সে বলবে: ‘অবশ্যই। তিনি বলেন: অতঃপর তিনি বলবেন: ‘তুমি কি ভেবেছিলে যে আমার সাথে তোমার সাক্ষাৎ ঘটবে?’ সে বলবে: না। অতঃপর তিনি বলবেন: ‘নিশ্চয় আমি তোমাকে ভুলে যাব যেভাবে তুমি আমাকে ভুলে গিয়েছিলে।’ অতঃপর দ্বিতীয় ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত করবেন এবং বলবেন: ‘হে অমুক! আমি কি তোমাকে সম্মানিত করিনি, তোমাকে নেতৃত্ব দেইনি, তোমাকে বিয়ে করাইনি এবং তোমার জন্য ঘোড়া ও উট অনুগত করে দেইনি, তোমাকে গোত্রপ্রধান বানাইনি ও গোত্রপ্রধানের গনীমতের ভাগ (এক চতুর্থাংশ) নিতে দেইনি?’ সে বলবে: ‘অবশ্যই, হে আমার রব।’ তখন তিনি বলবেন: ‘তুমি কি ভেবেছ আমার সাথে তোমার সাক্ষাৎ ঘটবে?’ সে বলবে: ‘না।’ অতঃপর তিনি বলবেন: ‘নিশ্চয় আমি তোমাকে ভুলে যাব যেভাবে তুমি আমাকে ভুলে গিয়েছিলে।’ অতঃপর তৃতীয় ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত করবেন, তাকেও একই রকম কথা বলবেন। সে বলবে: ‘হে আমার রব! আমি আপনার উপর, আপনার কিতাব ও রাসূলদের উপর ঈমান এনেছি, সালাত আদায় করেছি, সিয়াম পালন করেছি, দান-সদকা করেছি।’ সে সাধ্যমত নিজের গুণাগুণ বর্ণনা করবে। তিনি বলবেন: ‘তাহলে এখানে অপেক্ষা কর।’ তিনি বলেন: অতঃপর তাকে বলা হবে: ‘এখন আমি তোমার বিপক্ষে আমার সাক্ষী উপস্থিত করছি।’ সে মনে মনে চিন্তা করবে আমার বিপক্ষে কে সাক্ষী দিবে? তখন তার মুখে কুলুপ এঁটে দেয়া হবে এবং তার রান, গোস্ত ও হাড্ডিকে বলা হবে: ‘কথা বলো।’ ফলে তার রান, গোশত ও হাড্ডি তার আমলের বর্ণনা দিবে। আর এটি এ জন্যে যে, যেন সে লোক আল্লাহর কাছে ওজর পেশ করতে না পারে। এই ব্যক্তি হচ্ছে মুনাফিক, তার উপরই আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন।”[মুসলিম (২৯৬৮)]
শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘অতঃপর অবশ্যই তোমরা সেদিন নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’ আলেমরা আয়াতটির ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। এখানে তোমরা দ্বারা কি কাফের উদ্দেশ্য? নাকি মুমিন-কাফের উ্ভয়ে উদ্দেশ্য? সঠিক মত হচ্ছে এর দ্বারা মুমিন-কাফের উভয়ে উদ্দেশ্য। প্রত্যেককে নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। কিন্তু কাফেরকে ধমক ও তিরস্কারের স্বরে প্রশ্ন করা হবে। অন্যদিকে মুমিনকে আল্লাহর নিয়ামত স্মরণ করানোর জন্য প্রশ্ন করা হবে; যাতে সে আনন্দিত হয় এবং জানে যে যিনি দুনিয়াতে তাদেরকে এই সমস্ত নিয়ামত দিয়েছেন তিনিই আখিরাতে তাদেরকে নিয়ামত দিয়ে সম্মানিত করবেন। পক্ষান্তরে কাফেরকে ধমক ও তিরস্কারের জন্য প্রশ্ন করা হবে।’[সমাপ্ত][লিকাউল বাবিল মাফতূহ (৯/৯৮) থেকে সংক্ষেপিত]
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।