কখন গোসল করা ওয়াজিব; আর কখন গোসল করা মুস্তাহাব?

প্রশ্ন: 81949

স্বপ্নদোষের পর কি গোসল ওয়াজিব? নাকি কেবল (যৌন) মেলামেশার পর? কোন কোন অবস্থায় গোসল করা ওয়াজিব কিংবা কোন কোন অবস্থায় মুস্তাহাব?

উত্তরের সার-সংক্ষেপ

যে সকল অবস্থায় গোসল করা ওয়াজিব:

  • বীর্য নির্গত হওয়া।
  • দুই লজ্জাস্থান মিলিত হওয়া।
  • হায়েয (ঋতুস্রাব)।
  • নিফাস (প্রসবোত্তর স্রাব)।

যে সকল অবস্থায় গোসল করা মুস্তাহাব:

  • মানুষের জমায়েতের স্থানে (যাওয়ার পূর্বে)।
  • শরীরের গন্ধ বদলে গেলে।
  • কিছু ইবাদতের সময়ে, যেমন: ইহরামের জন্য গোসল করা।

যে সকল অবস্থায় গোসল আবশ্যক হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে:

  • মৃত ব্যক্তির গোসল।
  • মৃত ব্যক্তিকে গোসলদানকারী ব্যক্তির গোসল।
  • জুমার গোসল।
  • ইসলাম গ্রহণের সময় কাফেরের গোসল।
সংশ্লিষ্ট প্রশ্নোত্তরসমূহ

উত্তর

গোসল করা কখনো ওয়াজিব, আবার কখনো মুস্তাহাব। আলেমগণ এই সমস্ত অবস্থা উল্লেখ করেছেন। আলেমদের বক্তব্যগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়:

গোসল ওয়াজিবকারী মতৈক্যপূর্ণ বিষয়াবলি:

এক: গোসল ওয়াজিব করে এমন যে সমস্ত বিষয়ে মতৈক্য রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে:

  • বীর্য নির্গত হওয়া; এমনকি সেটা সহবাস ছাড়া হলেও।

আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা (৩১/১৯৫)-তে এসেছে: ‘ফকীহরা একমত যে বীর্য নির্গত হওয়া গোসল ওয়াজিব হওয়ার অন্যতম কারণ। বরং ইমাম নববী এ ব্যাপারে ইজমা (ঐকমত্য) বর্ণনা করেছেন। এক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মাঝে কিংবা ঘুমন্ত অবস্থা বা জাগ্রত অবস্থার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এর সপক্ষে দলীল হচ্ছে আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস, তিনি বর্ণনা করেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “কেবল পানি (বীর্য) থেকে পানি (গোসল) (আবশ্যক) হয়।”[হাদীসটি মুসলিম (৩৪৩) বর্ণনা করেন] এর অর্থ হচ্ছে যেমনটি ইমাম নববী বর্ণনা করেছেন: সবেগে নির্গত পানি তথা বীর্যের কারণে গোসল আবশ্যক হয়।’[সমাপ্ত]

  • দুই লজ্জাস্থান মিলিত হয়ে পুরুষের লিঙ্গের অগ্রভাগ নারীর লিঙ্গের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেলেই গোসল আবশ্যক হবে; যদিও বীর্য নির্গত না হয়।
  • হায়েযের (ঋতুস্রাবের) পর।
  • নিফাসের (প্রসবোত্তর স্রাবের) পর।

আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা (৩১/২০৪)-তে এসেছে: ‘ফকীহরা একমত যে হায়েয ও নিফাস গোসল ওয়াজিবকারী বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্ত। ইবনুল মুনযির ও ইবনে জারীর আত-ত্বাবারী ও অন্যান্যরা এ প্রসঙ্গে ইজমা তথা ঐকমত্য বর্ণনা করেছেন। হায়েযের ফলে গোসল ওয়াজিব হওয়ার দলীল হচ্ছে আল্লাহর বাণী:

وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْمَحِيضِ قُلْ هُوَ أَذًى فَاعْتَزِلُواْ النِّسَاء فِي الْمَحِيضِ وَلاَ تَقْرَبُوهُنَّ حَتَّىَ يَطْهُرْنَ فَإِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ أَمَرَكُمُ اللّهُ

“তারা তোমার কাছে হায়েয (মহিলাদের ঋতুস্রাব) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। তুমি বলো, সেটা কষ্টদায়ক (সঙ্গমের ক্ষেত্রে)। অতএব, হায়েযের সময়ে তোমরা নারীদেরকে পরিত্যাগ করো (হায়েযের স্থান পরিত্যাগ করো) এবং তারা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের কাছে যেয়ো না (তাদের সাথে সঙ্গম করো না)। যখন তারা পবিত্র হয়ে যাবে তখন আল্লাহ যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন সেভাবে তাদের কাছে যেতে পারবে (সঙ্গম করতে পারবে)।”[সূরা বাকারা: ২২২][সমাপ্ত]

কখন গোসল করা মুস্তাহাব; আর কখন ওয়াজিব?

দুই: যে সমস্ত অবস্থায় গোসল করা ওয়াজিব না হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে; বরং গোসল করা মুস্তাহাব:

  • গণ জমায়েতের স্থানে। এর জন্য গোসল করা মুস্তাহাব:

ইমাম বাগাভী রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘যিনি মানুষের সাথে সমবেত হতে চান তার জন্য গোসল করা, পরিচ্ছান্ন হওয়া ও সুগন্ধি লাগানো মুস্তাহাব।’

এমন সমাবেশের মধ্যে রয়েছে: দুই ঈদের গোসল। ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ আল-মাজমূ (২/২৩৩) গ্রন্থে বলেন: ‘সর্বসম্মতিক্রমে প্রত্যেকের জন্য এটি সুন্নাহ। হোক সে পুরুষ, নারী বা শিশু। কারণ এই দিনে গোসল করা হয় সাজসজ্জা হিসেবে। আর এরা সবাই সাজসজ্জা করার উপযুক্ত।’[সমাপ্ত]

এর মধ্যে আরো অন্তর্ভুক্ত হবে: সূর্যগ্রহণের নামায, বৃষ্টিপ্রার্থনার নামায, আরাফায় অবস্থান, মাশআরুল হারামে অবস্থান, আইয়্যামে তাশরীকে পাথর নিক্ষেপ প্রভৃতি ইবাদতকেন্দ্রিক বা প্রথাকেন্দ্রিক গণজমায়েত উপলক্ষে গোসল করা।

  • শারীরিক পরিবর্তন ঘটলে। শাফেয়ী ফকীহ আল-মাহামেলী বলেন: যে সকল অবস্থায় শারীরিক পরিবর্তন ঘটে এর প্রতিটিতে গোসল করা মুস্তাহাব।

এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত: ফকীহদের বক্তব্য অনুযায়ী পাগল ও অজ্ঞান ব্যক্তির জ্ঞান ফিরলে তাকে গোসল করানো মুস্তাহাব হওয়া। এছাড়া শিঙ্গা লাগানোর পরে, হাম্মামে ঢোকার পরে গোসল করা প্রভৃতি। কেননা গোসল শরীরে লেগে থাকা বস্তু দূর করে শরীরকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনে।[দেখুন: আল-মাজমূ (২/২৩৪, ২৩৫)]

  • কিছু কিছু ইবাদতের সময়ে। যেমন: ইহরামের জন্য গোসল করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরামের জন্য সেলাইকৃত কাপড় খুলে লুঙ্গি ও চাদর পরেন এবং গোসল করেন।[হাদীসটি তিরমিযী (৮৩০) বর্ণনা করেন] তাওয়াফে যিয়ারা, বিদায়ী তাওয়াফ এবং কদরের রাতের জন্য গোসল করা মুস্তাহাব হওয়ার বিষয়টি ফকীহরা উল্লেখ করেছেন। ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু মক্কায় প্রবেশ করলে গোসল করতেন। তিনি বলতেন যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটি করতেন।[হাদীসটি বুখারী (১৪৭৮) ও মুসলিম (১২৫৯) বর্ণনা করেন]

গোসল ওয়াজিবকারী মতভেদপূর্ণ অবস্থাসমূহ:

তিন: যে সমস্ত ক্ষেত্রে গোসল করার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে এবং অগ্রগণ্য মতের উল্লেখসহ:

  • মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়া:

অধিকাংশ আলেম একমত যে মৃত্যুবরণ গোসলকে ওয়াজিবকারী। দলিল হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেয়ে মারা যাওয়ার পরে তিনি বলেছেন: ‘তোমরা তাকে তিন বা পাঁচ বা এর চেয়ে বেশি বার গোসল করাও।’[হাদীসটি বুখারী (১২৫৩) ও মুসলিম (৯৩৯) বর্ণনা করেন]

  • মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়ার কারণে গোসল করা:

এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হাদীসের বিধান প্রসঙ্গে মতভিন্নতার ফলে আলেমরা উক্ত বিধানের ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘কেউ যদি কোনো মৃত ব্যক্তিকে গোসল করায় সে যেন গোসল করে।’[হাদীসটি ইমাম আহমদ (২/৪৫৪), আবু দাউদ (৩১৬১) ও তিরমিযী (৯৯৩) বর্ণনা করেন। তিনি বলেন: এটি হাসান হাদীস। ইমাম আহমদ থেকে ‘মাসাইলু আহমদ লি-আবি দাউদ’ গ্রন্থে বর্ণিত, তিনি বলেন: এ প্রসঙ্গে কোনো হাদীস প্রমাণিত নয়।]

শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ ‘আশ-শারহুল মুমতি’ (১/৪১১) গ্রন্থে বলেন: ‘মুস্তাহাব হওয়ার মতটি মধ্যমপন্থী ও সঠিক হওয়ার নিকটবর্তী মত।’[সমাপ্ত]

  • জুমার গোসল:

ইমাম নববী ‘আল-মাজমূ’ (২/২৩২) গ্রন্থে বলেন: ‘অধিকাংশের মতে এটি সুন্নাহ। সালাফদের কারো কারো মতে, এটি ওয়াজিব।’[সমাপ্ত]

সঠিক মত হচ্ছে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যার বাছাইকৃত মত। ‘আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা’ (৫/৩০৭) গ্রন্থে তার বক্তব্য: ‘যার শরীরের ঘাম অথবা দুর্গন্ধ থেকে অন্য কেউ কষ্ট পায় তার জন্য জুমার দিনে গোসল করা ওয়াজিব।’

  • কাফের ব্যক্তি মুসলিম হলে:

আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা (৩১/২০৫-২০৬)-তে এসেছে:

‘মালেকী ও হাম্বলীরা মনে করেন যে কোন কাফেরের ইসলামগ্রহণ করা তার উপর গোসল করাকে ওয়াজিবকারী। তাই কোন কাফের ইসলাম গ্রহণ করলে তার উপর গোসল করা ওয়াজিব হয়ে যায়। এর দলীল হচ্ছে:

আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: সুমামা ইবনে আসাল রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণ করার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘তোমরা তাকে নিয়ে অমুকের বাগানে গিয়ে তাকে গোসল করতে বলো।’

কাইস ইবনে আসেম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি ইসলাম গ্রহণ করার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে পানি এবং বরই পাতা দিয়ে গোসল করার নির্দেশ দেন।

তাছাড়া কাফের অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপবিত্র (জুনুবী) অবস্থায় থাকে। তাই উক্ত সম্ভাবনাকে প্রকৃত অবস্থার স্থলে স্থান দেওয়া হয়েছ। যেমনিভাবে ঘুমের কারণে এবং দুই লজ্জাস্থান মিলিত হওয়ার কারণে গোসল আবশ্যক হয়।

হানাফী ও শাফেয়ীরা মনে করেন যে কাফের ইসলাম গ্রহণ করলে এবং জুনুবী অবস্থায় না থাকলে তার জন্য গোসল করা মুস্তাহাব। কারণ এমন বহু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে যাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোসলের নির্দেশ দেননি। তবে যদি কাফের জুনুবী অবস্থায় ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে তার জন্য গোসল করা ওয়াজিব। ইমাম নববী বলেন: শাফেয়ী এমনটি বলেছেন আর তার অধিকাংশ সাথী এতে একমত পোষণ করেছেন।’

শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ ‘আশ-শারহুল মুমতি’ (১/৩৯৭) গ্রন্থে বলেন: ‘নিরাপদ মত হচ্ছে গোসল করা।’[সমাপ্ত]

আরো বিস্তারিত জানতে (83172, 292730 , 105360 , 6962, 7529 ) নং প্রশ্নের উত্তরগুলো পড়ার অনুরোধ রইল।

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

সূত্র

সূত্র

ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

answer

সংশ্লিষ্ট প্রশ্নোত্তরসমূহ

at email

নিউজলেটার

ওয়েবসাইটের ইমেইল ভিত্তিক নিউজলেটারে সাবস্ক্রাইব করুন

phone

ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব অ্যাপ্লিকেশন

কন্টেন্টে আরও দ্রুত পৌঁছতে ও ইন্টারনেট ছাড়া ব্রাউজ করতে

download iosdownload android