শিকারের উদ্দেশ্যে কিংবা গবাদি পশুকে পাহারা দেওয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো লক্ষ্যে কুকুর প্রতিপালন করা জায়েয নেই। ঘর পাহারা দেওয়ার জন্য কুকুর রাখা যাবে, তবে শর্ত হচ্ছে ঘর শহরের বাইরে হওয়া এবং বিকল্প কোনো উপায় না থাকা। মুসলিমের জন্য কুকুরের সাথে দৌঁড়ের মাধ্যমে কাফেরদের অনুকরণ করা জায়েয নেই। কুকুরের মুখ স্পর্শ করা ও চুম্বন করা বহুবিধ রোগের কারণ।
কুকুর পালন করা, স্পর্শ করা ও চুম্বন করা
প্রশ্ন: 69840
কুকুর পালন নাপাকির অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু যদি কেবল ঘর পাহারা দেওয়ার জন্য কোনো মুসলিম কুকুর পালে, কুকুরকে ঘরের বাইরে রাখে এবং ঘরের চৌহদ্দির শেষ প্রান্তে রাখে তাহলে তার জন্য কীভাবে নিজেকে পবিত্র রাখা সম্ভব? সে যদি নিজেকে পরিষ্কার করার জন্য কোনো মাটি বা ধুলা না পায় তাহলে এর হুকুম কী? মুসলিমের জন্য নিজেকে পবিত্র করার ক্ষেত্রে এর কোনো বিকল্প আছে কী? কখনো কখনো দেখা যায় উল্লিখিত ব্যক্তি কুকুরকে দৌঁড়ের সঙ্গী বানায়, কুকুরের উপর হাত বুলিয়ে দেয়, কুকুরকে চুম্বন করে, ইত্যাদি।
উত্তরের সার-সংক্ষেপ
উত্তর
বিষয়সূচী
কুকুর পালনের হুকুম:
পবিত্র শরীয়ত মুসলিমের জন্য কুকুর পালন হারাম করেছে। যে ব্যক্তি এই বিধান লঙ্ঘন করবে শরিয়ত তার নেকী থেকে এক কীরাত বা দুই কীরাত হ্রাস করার শাস্তি নির্ধারণ করেছে। তবে এর থেকে শিকারের জন্য এবং গবাদিপশু ও শস্যক্ষেত পাহারা দেওয়ার জন্য কুকুর প্রতিপালনকে ব্যতিক্রম হিসেবে গণ্য করেছে।
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি গৃহপালিত পশুর রক্ষণাবেক্ষণ বা শিকার করার জন্য অথবা শস্য ক্ষেত পাহারা দেয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে কুকুর পোষে প্রতিদিন তার নেক আমল থেকে এক কীরাত পরিমাণ কমতে থাকবে।”[হাদীসটি মুসলিম (১৫৭৫) বর্ণনা করেন]
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি পালিত পশুর রক্ষাকারী কিংবা শিকারী কুকুর ছাড়া অন্য কুকুর পালে তার আমল থেকে প্রতিদিন দুই কীরাত পরিমাণ সওয়াব কমে যায়।”[হাদীসটি বুখারী (৫১৬৩) ও মুসলিম (১৫৭৪) বর্ণনা করেন]
ঘর পাহারা দেওয়ার জন্য কি কুকুর পালন করা জায়েয?
ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘এই তিনটি উদ্দেশ্যে ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে কুকুর পালন করার বৈধতা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। যেমন: ঘর ও রাস্তা পাহারা দেয়া। প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত হচ্ছে হাদীসে উল্লিখিত তিনটি উদ্দেশ্যের কারণের উপর কিয়াস করে এটি জায়েয। সেই কারণটি হচ্ছে: 'প্রয়োজন'।’[সমাপ্ত][শরহু মুসলিম (১০/২৩৬)]
শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘সুতরাং যে ঘর নগরের অভ্যন্তরে থাকে সেটি পাহারা দেওয়ার জন্য কুকুর পালনের প্রয়োজন নেই। এমন অবস্থায় এই উদ্দেশ্যে কুকুর পালন করা হারাম; নাজায়েয। এমন কুকুর প্রতিপালনকারীদের নেকী থেকে প্রতিদিন এক কীরাত বা দুই কীরাত করে কমবে। সুতরাং তাদের উচিত এই কুকুর পালন না করে তাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু. যদি ঘরটি এমন জনশূন্য স্থানে হয় যার আশপাশে মানুষজন নেই, তাহলে তার জন্য ঘর ও ঘরের মানুষের পাহারার জন্য কুকুর পালন করা জায়েয। গবাদিপশু ও শস্যক্ষেত পাহারা দেওয়ার চেয়ে ঘরের লোকজন পাহারা দেওয়া বেশি দরকারী।’[সমাপ্ত][মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে উছাইমীন (৪/২৪৬)]
এক কীরাত ও দুই কীরাতের বর্ণনার মাঝে সামঞ্জস্যের ক্ষেত্রে কিছু মতামত রয়েছে, যথা:
হাফেয আইনী রাহিমাহুল্লাহ বলেন:
- এটি দুই শ্রেণীর কুকুরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে; দুই শ্রেণীর মধ্যে এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীর চেয়ে বেশি কষ্টদায়ক।
- কারো মতে: শহরাঞ্চলে ও গ্রামাঞ্চলে দুই কীরাত, আর মরু অঞ্চলে এক কীরাত।
- কারো কারো মতে: ভিন্ন ভিন্ন সময়ে উদ্ধৃত। প্রথমে এক কীরাত উল্লেখ করা হয়েছিল। পরে তীব্রতা বৃদ্ধি করে দুই কীরাত উল্লেখ করেছেন।[উমদাতুল কারী (১২/১৫৮)]
কুকুর কি নাপাক?
প্রশ্নকর্তার বক্তব্য: ‘কুকুর পালন নাপাকির অন্তর্ভুক্ত’ কথাটি এমন শর্তহীনভাবে সঠিক নয়। কারণ কুকুরের সত্তা নাপাক নয়; বরং কুকুরের লালায় নাপাকি আছে; যখন সে কোনো পাত্র থেকে পান করে। সুতরাং যে ব্যক্তি কুকুর স্পর্শ করল কিংবা কুকুর তাকে স্পর্শ করল তার জন্য নিজেকে মাটি কিংবা পানি দিয়ে পবিত্র করা আবশ্যক নয়। যদি কুকুর কোনো পাত্র থেকে পান করে, আর কেউ ঐ পাত্রটি ব্যবহার করতে চায়; তাহলে সেই পাত্রের পানি ফেলে দিয়ে সাতবার পানি দিয়ে এবং অষ্টমবার মাটি দিয়ে ঐ পাত্র ধুয়ে ফেলতে হবে। আর যদি সেটি কুকুরের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয় তাহলে সেটি ধোয়া আবশ্যকীয় নয়।
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “কুকুর কোন পাত্রে পান করলে সেই পাত্রকে পবিত্র করতে হলে সেটাকে সাতবার ধৌত করতে হবে। এর মধ্যে প্রথমবার মাটি দিয়ে (মাজতে হবে)।”[হাদীসটি মুসলিম (২৭৯) বর্ণনা করেন]
মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় (২৮০) আছে: ‘কুকুর যদি কোনো পাত্রে পান করে তাহলে সেটি সাতবার ধৌত করতে হবে। আর অষ্টমবার মাটি দিয়ে ধৌত করতে হবে।’
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা রাহিমাহুল্লাহ বলেন:
‘কুকুরের ব্যাপারে আলেমরা তিনটি মতে বিভক্ত। প্রথম মত হচ্ছে: কুকুর পবিত্র; এমনকি কুকুরের লালাও। এটি মালেকের মাযহাব। দ্বিতীয় মত হচ্ছে: এটি অপবিত্র; এমনকি পশমও। এটি শাফেয়ীর মাযহাব এবং ইমাম আহমদের বর্ণনাদ্বয়ের একটি। তৃতীয় মত হচ্ছে: এর পশম পবিত্র; লালা অপবিত্র। এটি ইমাম আবু হানীফা ও আহমাদের অন্য বর্ণনা। এই মতটি বিশুদ্ধতম। তাই যদি কোনো পোশাকে বা কাপড়ে কুকুরের পশমের সিক্ততা স্পর্শ করে তাতে সেটি অপবিত্র হয়ে যায় না।’[সমাপ্ত][মাজমুউল ফাতাওয়া (২১/৫৩০)]
অন্য স্থানে তিনি বলেন:
‘কেননা বস্তুর মূল অবস্থা হচ্ছে পবিত্রতা। সুতরাং কোনো দলীল ছাড়া কোনো কিছুকে অপবিত্র বা হারাম বলা জায়েয নেই। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেন:
وَقَدْ فَصَّلَ لَكُمْ مَا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلاَّ مَا اضْطُّرِرْتُم إِلَيْهِ
“আল্লাহ তোমাদের জন্য যা যা হারাম করেছেন বিস্তারিতভাবে সেগুলোর বিবরণ দিয়েছেন; অবশ্য নিরুপায় হয়ে তোমরা কিছু খেতে বাধ্য হলে তার কথা আলাদা।”[সূরা আন’আম: ১১৯]
তিনি আরো বলেন:
وَمَا كَانَ اللهُ لِيُضِلَّ قَوْماً بَعْدَ إِذْ هَدَاهُم حَتَّى يُبَيِّنَ لَهُم مَا يَتَّقُونَ
“কোনো সম্প্রদায়কে পথ দেখানোর পর তারা কি কি পরিহার করবে তা স্পষ্টভাবে বলে না দেওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তাদেরকে বিপথগামী করেন না। আল্লাহ সবকিছু ভালোভাবে জানেন।”[সূরা তাওবাহ: ১১৫]
... বিষয়টি যেহেতু এমন তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “কুকুর কোন পাত্রে পান করলে সেই পাত্রকে পবিত্র করতে হলে সেটাকে সাতবার ধৌত করতে হবে। এর মধ্যে প্রথমবার মাটি দিয়ে (মাজতে হবে)।” অন্য হাদীসে বলেছেন: “যদি কুকুর পান করে...” এ সংক্রান্ত সমস্ত হাদীসে কেবল ولوغ (জিহ্বা দিয়ে পান করা)-এর কথা বলা হয়েছে; বাকি কোনো অঙ্গের কথা উল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং অন্যান্য অঙ্গকে নাপাক বলার ভিত্তি হচ্ছে কিয়াস।
অধিকন্তু, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিকারের কুকুর এবং গবাদিপশু ও শস্যক্ষেত পাহারার কুকুর প্রতিপালনে ছাড় দিয়েছেন। যে ব্যক্তি এ ধরণের কুকুর পালে নিঃসন্দেহে তার শরীরে কুকুরের পশমের সিক্ততা লেগে যায়; যেমনিভাবে খচ্চর, গাধা বা অন্যান্য প্রাণীর সিক্ততা লাগে। তাই কুকুরের পশম নাপাক বলার মত এমন সংকীর্ণ পরিস্থিতি থেকে এ উম্মাহকে মুক্ত রাখা হয়েছে।’[সমাপ্ত][মাজমুউল ফাতাওয়া (২১/২১৭, ২১৯)]
তবে কেউ যদি হাতে সিক্ততা থাকা অবস্থায় কুকুরকে স্পর্শ করে অথবা কুকুর সিক্ত থাকা অবস্থায় সেটিকে স্পর্শ করে তাহলে সতর্কতা হিসেবে হাতকে সাতবার ধুয়ে ফেলবে। এর মধ্যে একবার মাটি দিয়ে ধৌত করবে।
শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘কুকুর স্পর্শ করার প্রসঙ্গে কথা হলো: যদি সিক্ততা ছাড়া স্পর্শ করে তাহলে হাত নাপাক হয় না। আর যদি সিক্তা থাকা অবস্থায় স্পর্শ করে তাহলে অনেক আলেমের মতে এতে করে হাত নাপাক হয়ে যায় এবং হাত সাতবার ধৌত করা ওয়াজিব হয়; এর মধ্যে একবার মাটি দিয়ে ধোয়া।[সমাপ্ত][মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে উছাইমীন (১১/২৪৬)]
কুকুরের নাপাকি থেকে পবিত্রতা অর্জনের পদ্ধতি:
কুকুরের নাপাকি থেকে পবিত্রতা অর্জনের পদ্ধতির বিবরণ (46314) ও (41090) নং প্রশ্নের উত্তরে দেওয়া হয়েছে।
এক্ষেত্রে সাতবার কুকুরের নাপাকি ধুয়ে ফেলার পর একবার মাটি দিয়ে ধুয়ে ফেলা ওয়াজিব। মাটি থাকলে সেটি ব্যবহার করা ওয়াজিব; অন্য কিছু মাটির বিকল্প হবে না। আর যদি মাটি না পায় তাহলে পবিত্র করে এমন অন্যান্য বস্তু যেমন সাবান ব্যবহার করতে সমস্যা নেই।
কুকুরকে চুম্বন করা কি জায়েয?
প্রশ্নকর্তা কুকুরকে চুম্বন করার যে বিষয়টি উল্লেখ করেছে তা বহু রোগের কারণ ঘটায়। শরীয়তের বিধান লঙ্ঘন করে কুকুরকে চুম্বন করা অথবা কুকুরের পান করা পাত্র পবিত্র করার আগে তা থেকে পান করার ফলে মানুষ বহু রোগে আক্রান্ত হয়।
এর মধ্যে রয়েছে: পাস্তুরেলোসিস রোগ। এটি হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ। এর জীবাণু সাধারণত পশু ও মানুষের শ্বাসতন্ত্রে প্রাকৃতিকভাবে বিদ্যমান থাকে। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে এই জীবাণু শরীরকে আক্রান্ত করে রোগ সৃষ্টি করে।
এর মধ্যে আরো রয়েছে: ইচিনোকোকোসিস রোগ। এটি পরজীবীঘটিত একটি রোগ যা মানুষ ও প্রাণীর অন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায় এবং সাধারণত লিভার, ফুসফুস, পেটের গহ্বর এবং শরীরের অন্যান্য অংশে প্রভাব ফেলে।
এই রোগের কারণে ‘ইকাইন্কুস ক্রানিলোসিস’ নামক এক ধরনের ফিতাকৃমির উৎপত্তি হয়। এগুলো ছোট কীট, দৈর্ঘ্যে প্রায় ২ থেকে ৯ মিলিমিটার। তিনটি অংশ নিয়ে এগুলো গঠিত: মাথা, গলা ও দেহ। মাথায় চারটি শোষক অঙ্গ থাকে।
এই শ্রেণীর প্রাপ্তবয়স্ক কৃমিগুলো তাদের বাহক প্রাণী যেমন- কুকুর, বিড়াল, শিয়াল ও নেকড়ের অন্ত্রে বাস করে।
যখন কোন কুকুর প্রতিপালক কুকুরকে চুমু খায় বা তাদের পাত্র থেকে পানি পান করে তখন এই রোগ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।
[দেখুন: ড. আলী ইসমাঈল উবাইদ আস-সিনাফী রচিত ‘আমরাদুল হাইওয়ানাতুল আলীফা আল্লাতি তুসীবুল ইনসান’ গ্রন্থ]
সারকথা হচ্ছে:
শিকারের উদ্দেশ্যে কিংবা গবাদি পশুকে পাহারা দেওয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো লক্ষ্যে কুকুর প্রতিপালন করা জায়েয নেই। ঘর পাহারা দেওয়ার জন্য কুকুর রাখা যাবে, তবে শর্ত হচ্ছে ঘর শহরের বাইরে হওয়া এবং বিকল্প কোনো উপায় না থাকা। মুসলিমের জন্য কুকুরের সাথে দৌঁড়ের মাধ্যমে কাফেরদের অনুকরণ করা জায়েয নেই। কুকুরের মুখ স্পর্শ করা ও চুম্বন করা বহুবিধ রোগের কারণ।
এই পবিত্র পূর্ণাঙ্গ শরীয়তের জন্য সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। এই শরীয়ত এসেছে মানুষের দ্বীন ও দুনিয়া সংশোধনের লক্ষ্যে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
সূত্র:
ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব