ধর্মের প্রতি মানুষের মুখাপেক্ষিতা জীবনের অন্য সব জরুরী বিষয়ের প্রতি মুখাপেক্ষিতার চেয়ে মুখ্য। কারণ মানুষকে অবশ্যই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির পয়েন্টগুলো জানা আবশ্যক। তাকে অবশ্যই এমন কিছু করতে হবে যা তার কল্যাণ সাধন করে এবং এমন কিছু করতে হবে যা তার অনিষ্টকে প্রতিহত করে। শরীয়ত-ই পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে কোন কাজ উপকারী ও কোন কাজ ক্ষতিকর। শরীয়ত সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর ইনসাফ এবং বান্দাদের মাঝে এটি আল্লাহর নূর। শরীয়ত ছাড়া মানুষের জন্য বসবাস করা সম্ভবপর নয়; যার মাধ্যমে তারা করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়ের মাঝে পার্থক্য করতে পারবে।
মানুষের যেহেতু ইচ্ছাশক্তি আছে সেহেতু তাকে জানতেই হবে সে কী চায়? সেটা কি উপকারী; নাকি ক্ষতিকর? সেটা কি তার কল্যাণ করবে; নাকি তাকে ধ্বংস করে দিবে?
এর কিছু বিষয় হয়তো কিছু মানুষ তার সহজাত প্রবৃত্তি (ফিতরাত) দিয়ে জানতে পারে। কিছু বিষয় নিজের বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে অবগত হতে পারে। আর কিছু বিষয় ততক্ষণ পর্যন্ত জানতে পারে না যতক্ষণ না রাসূলেরা সেগুলো তাদেরকে জানায়, ব্যাখ্যা করে এবং সেগুলোর দিকে দিক-নির্দেশনা প্রদান করে।[দেখুন: শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যার আত-তাদমুরিয়্যা (পৃ. ২১৩, ২১৪) ও মিফতাহু দারিস স’আদাহ (খণ্ড: ২, পৃ. ৩৮৩)]
নাস্তিক্যবাদী বস্তুবাদী মতাদর্শগুলো যত বাড়াবাড়ি করুক, যত চাকচিক্য দেখাক এবং নানা প্রকার চিন্তা ও মতাদর্শ নিয়ে হাজির হোক না কেন সেগুলো ব্যক্তি ও সমাজের জন্য সঠিক ধর্মের বিকল্প নয় এবং আত্মা ও শরীরের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম নয়। বরং ব্যক্তি যত বেশি এ মতাদর্শগুলোর গভীরে প্রবেশ করবে তত বেশি সে নিশ্চিত হবে যে এগুলো তাকে নিরাপত্তা দিতে পারে না, তার পিপাসা মেটাতে পারে না। এগুলো ছেড়ে সঠিক ধর্মে ফিরে আসা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। আর্নেস্ট রেনান বলেন: “আমরা যা কিছুকে ভালোবাসি তার সবই ফুরিয়ে যেতে পারে। বিবেক-বুদ্ধি, বিজ্ঞান ও শিল্প ব্যবহারের জীবন বাতিল হয়ে যেতে পারে, কিন্তু ধার্মিকতা বাতিল হওয়া অসম্ভব। বরং ধর্ম টিকে থাকবে বস্তুবাদী মতাদর্শ বাতিল হওয়ার পক্ষে প্রমাণ হিসেবে; যে মতাদর্শ মানুষকে পার্থিব জীবনের নিকৃষ্ট সংকীর্ণতায় বেঁধে ফেলতে চায়।”[দেখুন: আব্দুল্লাহ দাররায রচিত ‘আদ-দ্বীন’ (পৃ. ৮৭)]
মুহাম্মাদ ফরীদ ওয়াজদী বলেন: “ধার্মিকতার চিন্তা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া অসম্ভব। কারণ এটি মানুষের সর্বোত্তম মানবিক ঝোঁক ও শ্রেষ্ঠতম অনুভূতি। এমন এক ঝোঁক যা মানুষের মাথাকে উন্নীত করে। এই ঝোঁক আরও বৃদ্ধি পেতে থাকবে। মানুষ যতদিন বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন থেকে সুন্দর ও অসুন্দরকে চিনতে সমর্থ হবে ততদিন স্বভাবজাত ধার্মিকতা তাকে তাড়িয়ে বেড়াবে। তার অনুধাবনের মাত্রা যত উঁচু হবে, জ্ঞান-গরিমা যত বৃদ্ধি পাবে তার মাঝে এ সহজাত ধার্মিকতা ততই প্রবল হবে।”।[প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৭]
যখন মানুষ তার প্রভু থেকে দূরে সরে যায় তখন সে তার বোধগম্যতার মাত্রা ও জ্ঞানের প্রশস্ততা অনুসারে বুঝতে পারে যে, নিজের প্রভু ও তাঁর জন্য করণীয় সম্পর্কে সে কত অজ্ঞ, নিজের সম্পর্কেও সে কত অজ্ঞ, তার জন্য কী ভালো, কী খারাপ, কীসে তাকে সুখী করবে এবং কীসে তাকে অসুখী করবে সে সম্পর্কেও সে কত অজ্ঞ। সে বুঝতে পারে যে, জ্যোতির্বিদ্যা, ছায়াপথ বিজ্ঞান, কম্পিউটার বিজ্ঞান, নিউক্লিয়াসের খুঁটিনাটি সম্পর্কে সে কত অজ্ঞ...। তখন সে জ্ঞানী ব্যক্তি আত্মপ্রবঞ্চনা ও অহংকার থেকে বিনয় ও আত্মসমর্পনের দিকে ফিরে আসে এবং বিশ্বাস করে যে, এসব জ্ঞান-বিজ্ঞানের পেছনে একজন প্রজ্ঞাবান জ্ঞানী আছেন, প্রকৃতির পেছনে একজন সর্বশক্তিমান স্রষ্টা আছেন। এই সত্য একজন ন্যায়-বিচারক গবেষককে অদৃশ্যের প্রতি ঈমান আনতে, সঠিক ধর্ম গ্রহণ করতে এবং মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য করে...। যা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে একজন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি বিকৃত হয়ে যায় এবং সে নির্বাক পশুর চেয়ে অধমে পরিণত হয়।
এর থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, সত্য-দ্বীন গ্রহণ করা (যা আল্লাহর একত্ববাদ ও শরিয়ত অনুযায়ী তাঁর দাসত্ব করার উপর নির্ভরশীল) জীবনের জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান; যাতে করে এর মাধ্যমে ব্যক্তি বিশ্ব জগতের প্রভুর জন্য নিজের দাসত্বকে বাস্তবায়ন করতে পারে, দুনিয়া ও আখিরাতে ক্লান্তি, অবসাদ ও দুর্ভাগ্য থেকে নিজেকে নিরাপদ ও সুখে রাখতে পারে। মানুষের যুক্তিগত শক্তিকে পরিপূর্ণ করবার জন্যেও এটি অপরিহার্য। এর মাধ্যমেই মানুষের বিবেক তৃপ্তি খুঁজে পায়; এটি ছাড়া বিবেক তার উচ্চ আশা বাস্তবায়ন করতে পারে না।
এটি আত্মাকে শুদ্ধ করা ও আবেগকে পরিচর্যা করবার জন্যেও অপরিহার্য উপাদান। কারণ মহৎ আবেগগুলো ধর্মীয় অঙ্গনে উর্বর ভূমি ও নিরবধি ঝরনা খুঁজে পায়; লক্ষ্যের নাগাল পায়।
এটি ইচ্ছাশক্তিকে পরিপূর্ণ করবার জন্যেও অপরিহার্য; যেহেতু এটি ইচ্ছাশক্তিকে সর্বোত্তম প্রেরণা ও শ্রেষ্ঠ উদ্দীপনা সরবরাহ করে এবং নিরাশা ও হতাশার কারণগুলোকে প্রতিরোধ করার জন্য সর্বাধিক শক্তিশালী অস্ত্রে সুসঞ্জিত করে।
কেউ কেউ বলে থাকে: “মানুষ স্বভাবতঃই সামাজিক”, পূর্বের আলোচনার আলোকে আমাদের বলা উচিত: “মানুষ সহজাতভাবে ধার্মিক।”[দেখুন: প্রাগুক্ত (পৃ. ৮৪, ৯৮)] কারণ মানুষ দুই প্রকার শক্তির অধিকারী: জ্ঞানগত তত্ত্বীয় শক্তি ও জ্ঞানগত ইচ্ছাশক্তি। তার পূর্ণ সুখ-সৌভাগ্য এই দুই শক্তির পূর্ণতার উপর নির্ভর করে। জ্ঞানগত শক্তি নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানার মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে:
১- স্রষ্টা ও জীবিকাদাতা উপাস্যকে জানা, যিনি মানুষকে শূন্য থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার উপর অজস্র নিয়ামত ঢেলে দিয়েছেন।
২- আল্লাহর নাম ও গুণাবলি এবং কোন কোন বিষয়গুলো তাঁর জন্য আবশ্যকীয় সেগুলো জানা। তাছাড়া বান্দাদের উপর এই নামগুলোর প্রভাব জানা।
৩- যেই রাস্তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে দেয় সেই রাস্তা জানা।
৪- মানুষকে এই রাস্তাতে ও চিরন্তন সুখে পৌঁছতে বাধা দেয় এমন প্রতিবন্ধকতা ও বিপদ-আপদগুলো জানা।
৫- নিজেকে সত্যিকারভাবে জানা। আপনার নিজের কী প্রয়োজন, কী আপনার জন্য উপকারী বা অপকারী, নিজের মাঝে বিদ্যমান গুণাবলি ও দোষ-ত্রুটিগুলো জানা।
এই পাঁচ প্রকার জানার মাধ্যমে মানুষ তার জ্ঞানগত শক্তিকে পরিপূর্ণ করতে পারে। জ্ঞান ও ইচ্ছার শক্তি কখনও পরিপূর্ণতা পায় না যতক্ষণ না বান্দা তার উপর আল্লাহর অধিকারগুলো রক্ষা করে এবং নিষ্ঠার সাথে, আন্তরিকভাবে, কল্যাণকামিতা, অনুসরণ ও অনুগ্রহের স্বীকৃতি দিয়ে সেগুলোকে পালন করে । এ শক্তিদ্বয় পরিপূর্ণতা পাওয়ার কোন উপায় নেই আল্লাহর সাহায্য ছাড়া। কারণ বান্দা আল্লাহর দিকে অপরিহার্যভাবে মুখাপেক্ষী তিনি যেন তাকে সরল পথ দেখান যেভাবে তিনি তাঁর ওলিদেরকে (মিত্রদেরকে) পথ দেখিয়েছেন।[দেখুন: আল-ফাওয়াইদ (পৃ. ১৮-১৯)]
যখন আমরা জানতে পারলাম যে সঠিক ধর্ম মনের বিভিন্ন শক্তির জন্য ঐশী মদদ, সুতরাং ধর্মই সমাজের প্রতিরক্ষা ব্যূহ। কারণ মানবজীবন সমাজের সদস্যদের পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। এই সহযোগিতা ততক্ষণ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হবে না যতক্ষণ না কোন একটি বিধান তাদের সম্পর্কগুলোকে বিধিবদ্ধ করবে, দায়িত্বগুলো নির্ধারণ করবে এবং অধিকারগুলোকে নিশ্চিত করবে। এ বিধানের এমন কোন কর্তৃত্ব থাকা অনিবার্য যা কোন ব্যক্তিকে বিধান লঙ্ঘন করা থেকে প্রতিহত করবে, বিধান মেনে চলতে উৎসাহিত করবে, মানুষের মনের মধ্যে এর ভয় জাগ্রত রাখবে এবং এর সীমা অতিক্রম করা থেকে বারণ করবে। কী সেই কর্তৃত্ব? আমি বলব: পৃথিবীর বুকে ধার্মিকতার শক্তির মত বা এর কাছাকাছি অন্য কোনো শক্তি নাই; যে শক্তি আইনের সম্মান করা নিশ্চিত করবে, সামাজিক সংহতির গ্যারান্টি দিবে, শৃঙ্খলা স্থিতিশীল রাখবে এবং শান্তি ও নিরাপত্তার উপায়-উপকরণ একত্রিত করবে।
এর অন্তর্নিহিত কারণ হলো: মানুষ অন্য সকল প্রাণী থেকে এদিক থেকে আলাদা যে, তার ঐচ্ছিক কাজকর্ম এমন কিছুর দ্বারা পরিচালিত হয় যা চোখে দেখা যায় না ও কানে শোনা যায় না। তা হচ্ছে এমন এক ধর্মবিশ্বাস যা তার আত্মা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পরিশুদ্ধ করে। মানুষ সর্বদা বিশ্বাস দ্বারা পরিচালিত; সেটা সঠিক হোক বা ভুল হোক। যদি তার বিশ্বাস সঠিক হয় তাহলে তার সব কিছু সঠিক হয়। আর তার বিশ্বাস নষ্ট হলে সব কিছু নষ্ট হয়।
বিশ্বাস ও ধর্মবিশ্বাস উভয়টি মানুষের উপর স্বয়ংক্রিয় পর্যবেক্ষক। এই দু’টি (যেমনটি সর্বস্তরের মানুষদের মাঝে দেখা যায়) দুই প্রকার:
- সৎ গুণ, মানবিক মর্যাদা ও আরও যে সব মুক্ত মূল্যবোধ আছে সেগুলোর মূল্যে বিশ্বাস করা। উন্নত চরিত্রধারীরা যেগুলোকে লঙ্ঘন করতে সংকোচ বোধ করে; এমনকি যদি তাদেরকে এ লঙ্ঘনের বস্তুগত শাস্তি থেকে মুক্তি দেয়া হয় তবুও।
- মহান আল্লাহর প্রতি এই বিশ্বাস রাখা যে তিনি সকল গোপন বিষয়াবলির পর্যবেক্ষক, তিনি প্রকাশ্য ও গোপন সব বিষয় জানেন। তাঁর আদেশ-নিষেধ শরীয়তের কর্তৃত্বের উৎস। তাঁর প্রতি ভালোবাসা, তাঁকে ভয় করা কিংবা উভয়টির সমন্বয়ে অনুভূতিগুলো জ্বলে ওঠে। ... নিঃসন্দেহে উল্লেখিত প্রকারদ্বয়ের মধ্যে এই প্রকারটি মানুষের মনের উপর সর্বাধিক শক্তিশালী কর্তৃত্বশীল। কুপ্রবৃত্তির ঝড় ও আবেগ-অনুভূতির পরিবর্তনের মোকাবিলায় এই প্রকার বিশ্বাসই সর্বাধিক শক্তিশালী। সাধারণ ও বিশেষ মানুষদের মনে এটি সর্বাধিক দ্রুত পৌঁছে যায়।
এ কারণে ধর্ম হচ্ছে মানুষের পারস্পরিক আচার-ব্যবহারকে ন্যায় ও ইনসাফের মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত করার শ্রেষ্ঠ নিশ্চয়তা। এ কারণে ধর্ম একটি সামাজিক অনিবার্যতা। শরীরে হৃৎপিণ্ডের অবস্থান যেমন, মানবজাতির মাঝে ধর্মের অবস্থান তেমন; এতে বিস্ময়ের কিছু নেই্।[দেখুন: আদ-দ্বীন (পৃ. ৯৮, ১০২)] যদি সাধারণভাবে ধর্মের এ মর্যাদা হয়ে থাকে, তবে আজকের বিশ্বে বহু ধর্ম ও ধর্মীয় গোষ্ঠী লক্ষ্যণীয়। আপনি দেখবেন, প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীরা তাদের ধর্ম নিয়ে সন্তুষ্ট ও তাদের ধর্মকে আঁকড়ে ধরে আছে। কিন্তু, কোনটি সঠিক ধর্ম যা মানবাত্মা যে লক্ষ্যে পৌঁছতে চায় সেটি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে? সঠিক ধর্মের মূলনীতিগুলোই বা কী?