এক:
সংক্ষেপে নামাযের মাকরূহ সময় তিনটি। আর বিস্তারিত বললে নামাযের মাকরূহ সময় পাঁচটি। সেগুলো হলো:
- ফজর উদিত হওয়া থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত।
- সূর্যোদয় থেকে শুরু করে সূর্য একটি বর্শার দৈর্ঘ্য পরিমাণ ঊর্ধ্বে ওঠা পর্যন্ত। এই সময়টির দৈর্ঘ্য বারো মিনিট। সতর্কতা হিসেবে পনের মিনিট ধরা যায়।
- দ্বিপ্রহরে আসমানের মধ্যভাগে সূর্য অবস্থান নেওয়ার পরে সেখান থেকে হেলে পড়া পর্যন্ত।
- আসরের নামাযের পর থেকে সূর্যাস্ত যাওয়া পর্যন্ত।
- সূর্যাস্ত শুরু হলে তা পূর্ণভাবে ডুবে যবে যাওয়া পর্যন্ত।
আর সংক্ষেপে বললে:
- ফজর থেকে শুরু করে সূর্য বর্শার দৈর্ঘ্য পরিমাণ ঊর্ধ্বে ওঠা পর্যন্ত।
- দ্বিপ্রহরে কোনো দণ্ডের ছায়া উলম্ব অবস্থা থেকে হেলে পড়া পর্যন্ত।
- আসরের নামাযের পর থেকে সূর্যাস্ত যাওয়া পর্যন্ত।
দুই:
এই সময়গুলোতে নফল নামায পড়া নিষিদ্ধ। তবে ফরয আদায় করা অথবা ফরয কাযা করা নিষিদ্ধ নয়।
‘মূল বিধান হচ্ছে নফল নামায সর্বদা পড়া জায়েয। এর দলীল হলো আল্লাহ তাআলার বাণী:
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱرْكَعُواْ وَٱسْجُدُواْ وَٱعْبُدُواْ رَبَّكُمْ وَٱفْعَلُواْ ٱلْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা রুকু ও সিজদা করো (নামায পড়ো), তোমাদের রবের ইবাদত করো এবং অন্যান্য সৎকর্ম করো যাতে করে তোমরা সফলকাম হতে পারো।”[সূরা হজ্জ: ৭৭] এছাড়াও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিম্নোক্ত বাণীর ব্যাপকতা। এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি প্রয়োজন পূরণ করে দেওয়ার পরে তিনি তাকে বলেছিলেন: ‘তুমি কী চাও।’ লোকটি বলল: ‘আমি জান্নাতে আপনার সাহচর্য চাই।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘এছাড়া অন্য কিছু?’ লোকটি বলল: ‘এটাই চাই। এছাড়া অন্য কিছু চাই্ না।’ তিনি বললেন: ‘তাহলে তুমি বেশি বেশি সিজদা দিয়ে নিজের ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করো।’
সুতরাং নফল নামাযের ক্ষেত্রে মূল বিধান হলো এটি মুসাফির ও মুকীম উভয়ের জন্য সর্বদা বৈধ। কিন্তু শরীয়তপ্রণেতা কিছু নির্দিষ্ট সময়ে নামায পড়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। এমন সময় পাঁচটি ... ’[শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ রচিত ‘আশ-শারহুল মুমতি’ থেকে সমাপ্ত]
তিন:
নিষিদ্ধ সময়ে পড়া যাবে এমন কিছু নফল নামাযকে ফকীহরা ব্যতিক্রম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে:
১- তাওয়াফের দুই রাকাত নামায। কারণ তিরমিযী (৮৬৮), নাসাঈ (২৯২৪), আবু দাউদ (১৮৯৪), ইবনে মাজাহ (১২৫৪) বর্ণনা করেন: জুবাইর ইবনে মুত্বঈম রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “ওহে আব্দ মানাফের সন্তানেরা! এই ঘরকে কেন্দ্র করে দিনের বা রাতের কোনো সময়ে তাওয়াফ (প্রদক্ষিণ) করতে কিংবা নামায পড়তে তোমরা কাউকে বাধা দিবে না।” শাইখ আলবানী সহীহুত তিরমিযীতে এটিকে সহীহ বলে গণ্য করেছেন।
২- জামাত পেয়ে পুনরায় নামায পড়া। কেউ যদি ফরয নামায পড়ার পর মসজিদে গিয়ে দেখতে পায় একদল লোক জামাতের সাথে নামায পড়ছে তাহলে সে তাদের সাথে নামায পড়বে; যদিও সেটি নিষিদ্ধ সময়ে হয়ে থাকে। এমন অবস্থায় তাদের সাথে তার নামায পড়া নফল হিসেবে গণ্য হবে। কেননা তিরমিযী (২১৯) ও নাসাঈ (৮৫৮) বর্ণনা করেন: ইয়াযীদ ইবনুল আসওয়াদ আল-আমিরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন দুইজন লোককে লক্ষ্য করে বলেন যারা তাঁর সাথে নামায পড়েনি যেহেতু তারা নিজেদের ঘর থেকে নামায পড়ে এসেছিল: “তোমরা তোমাদের ঘরে নামায পড়ার পরে যদি মসজিদে এসে জামাত হতে দেখ, তাহলে তোমরা তাদের সাথে নামায পড়বে। এই নামায তোমাদের দুজনের জন্য নফল হিসেব গণ্য হবে।”[হাদীসটি শাইখ আলবানী সহীতুত তিরমিযীতে সহিহ বলে গণ্য করেন]
৩- সুন্নতে রাতেবা তথা ফরয নামাযের আগে-পরের সুন্নত আদায়ের পরিবর্তে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ার দরুন যদি নিষিদ্ধ সময় শুরু হয়ে যায়। অনুরূপভাবে যোহরের সাথে আসর একত্রে পড়লে যোহরের পরের সুন্নত আসরের নামাযের পরে পড়া যাবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার যোহরের পরের সুন্নতের বদলে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আসরের পরে সেটি আদায় করেন।[হাদীসটি বুখারী (১২৩৩) ও মুসলিম (৮৩৪) বর্ণনা করেন]
৪- যে ব্যক্তি জুমার দিন মসজিদে এমন সময়ে প্রবেশ করে যখন ইমাম খুতবা দিচ্ছেন। এমন সময়ে সে হালকাভাবে দুই রাকাত নামায পড়ে নিবে। কারণ বুখারী (৯৩১) ও মুসলিম (৮৭৫) বর্ণনা করেন: জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুতবা দেওয়ার সময় একবার এক লোক মসজিদে প্রবেশ করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন: ‘তুমি কি নামায পড়েছ?’ সে বলল: না। তিনি বললেন: ‘তুমি উঠে দাঁড়াও এবং দুই রাকাত নামায পড়ো।’
৫- নিষিদ্ধ লম্বা সময়গুলোতে জানাযার নামায পড়ার ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে। অর্থাৎ ফজর উদিত হওয়ার পর থেকে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত এবং আসরের নামাযের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
ইবনে কুদামা রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘ফজরের পর থেকে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত এবং আসরের পর থেকে সূর্য ডোবার জন্য হেলে পড়া পর্যন্ত জানাযার নামায পড়া বৈধ হওয়ার ব্যাপারে কোনো মতভেদ নেই।’ ইবনুল মুনযির বলেন: ‘আসর ও ফজরের পর জানাযার নামায পড়া বৈধ হওয়ার ব্যাপারে মুসলিমদের মাঝে ইজমা তথা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত।’
পক্ষান্তরে তিন সময়ে জানাযার নামায পড়া জায়েয নেই, যে সময়গুলোর কথা উকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণিত হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে।
‘তিনটি সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নামায পড়তে এবং মৃতদেরকে কবরস্থ করতে নিষেধ করেছেন।’ হাদিসে নামাযের সাথে দাফন একত্রে উল্লেখ করা প্রমাণ করে যে এখানে জানাযার নামাযকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। আল-আসরাম বলেন: আমি আবু আব্দুল্লাহকে (অর্থাৎ ইমাম আহমদকে) সূর্যোদয়ের সময়ে জানাযার নামায আদায় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন: ‘সূর্যোদয় চলমান অবস্থায় জানাযার নামায পড়া আমার পছন্দ নয়।’ তারপর তিনি উকবা ইবনে আমেরের হাদীসটি বর্ণনা করেন। এছাড়া জাবের ও ইবনে উমর থেকে অনুরূপ কথা বর্ণিত হয়েছে। ই্মাম মালেক মুয়াত্তা গ্রন্থে এ হাদিসটি ইবনে উমর থেকে বর্ণনা করেছেন। খাত্তাবী বলেন: এটি অধিকাংশ আলেমের মত।
ফজর ও আসরের পরে জানাযার নামায জায়েয হওয়ার কারণ হচ্ছে যেহেতু এই দুই সময় অনেক দীর্ঘ। অপেক্ষা করলে জানাযা (মৃতদেহ) ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ব্যাপারে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে, এই তিনটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের।[সমাপ্ত][আল-মুগনী (১/৪২৫) থেকে সংক্ষেপে সমাপ্ত]
চার:
কিছু নফল নামাযের ব্যাপারে ফকীহরা মতভেদ করেছেন যে, এগুলো কি নিষিদ্ধ সময়ে পড়া যাবে; নাকি যাবে না? এ ধরণের নামাযগুলোর মধ্যে রয়েছে: কোনো কারণের সাথে সম্পৃক্ত নফল নামায। যেমন: তাহিয়্যাতুল মাসজিদ (মসজিদে প্রবেশের নামায), অযুর নফল নামায। আলেমদের মধ্যে কেউ কেউ নিষিদ্ধ সময়ে এই নামায পড়া বৈধ বলেছেন। এটি ইমাম শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহ এর অভিমত। একদল আলেম এই মতটি গ্রহণ করেছেন। এটাই অগ্রগণ্য অভিমত। অন্যদিকে কেউ কেউ এর থেকে নিষেধ করেন। তারা নিছক নফল নামায ও বিশেষ কারণগত নফল নামাযের মধ্যে কোন পার্থক্য করেন না।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।