আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আপনার নতুন সন্তানে বরকত দান করেন এবং তাকে নেককার মুত্তাকীদের অন্তর্ভুক্ত করেন; যাতে করে সে আপনার নেক আমলের পাল্লায় স্থান লাভ করে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “আদম সন্তান মারা গেলে তার সকল আমল থেমে যায় কেবল তিনটি ছাড়া: সদকায়ে জারিয়া (প্রবহমান দান), এমন জ্ঞান যা উপকারী এবং এমন নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।”[হাদীসটি মুসলিম (১৬৩১) বর্ণনা করেন]
দুই:
আমাদের জানামতে নবজাতকের অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুতি হিসেবে তার জন্মের এক বা দুই দিন আগে কিংবা তার চেয়ে কম-বেশি দিনে করণীয় কোনো শরয়ি আমল নেই; কেবল সাধারণ কল্যাণকর দোয়াগুলো ছাড়া। যেমন: নবজাতকের নিরাপত্তা, সুস্থতা, হেদায়াত প্রভৃতির জন্য দোয়া করা। আল্লাহ তাআলা তার কিতাবে নেককার নারী ইমরানের স্ত্রীর দোয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। ইমরানের স্ত্রী দোয়া করেছিলেন:
إِذْ قَالَتِ امْرَأَةُ عِمْرَانَ رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِي بَطْنِي مُحَرَّرًا فَتَقَبَّلْ مِنِّي إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ(35) فَلَمَّا وَضَعَتْهَا قَالَتْ رَبِّ إِنِّي وَضَعْتُهَا أُنْثَى وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا وَضَعَتْ وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالْأُنْثَى وَإِنِّي سَمَّيْتُهَا مَرْيَمَ وَإِنِّي أُعِيذُهَا بِكَ وَذُرِّيَّتَهَا مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ(36)
“স্মরণ করো, যখন ইমরানের স্ত্রী বলল: ‘হে আমার প্রভু! আমার পেটে যে সন্তান রয়েছে তাকে আমি একান্তভাবে তোমার জন্য উৎসর্গ করলাম। আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে গ্রহণ করো। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী।”
তারপর যখন তিনি তাকে প্রসব করলেন তখন বললেন: ‘হে আমার প্রভু! আমি তো কন্যা সন্তান প্রসব করেছি’ – সে যা প্রসব করেছে তা তো আল্লাহই ভালো জানেন – ‘পুরুষ তো নারীর মতো নয়, আমি তার নাম দিয়েছি মারিয়ম, আর আমি তাকে ও তার সন্তান-সন্ততিকে অভিশপ্ত শয়তানের প্রভাব থেকে (রক্ষার জন্য) আপনার হেফাজতে দিচ্ছি।”[সূরা আলে-ইমরান: ৩৫-৩৬]
সন্তান আগমনের দিন এবং তার পরবর্তী দিনগুলোতে আপনার করণীয় সম্পর্কে নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
ক. নবজাতককে তাহনিক করানো এবং তার জন্য দোয়া করা মুস্তাহাব।
আবু মুসা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: ‘আমার একটি ছেলে সন্তান জন্ম নিলে আমি তাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে আসলাম। তিনি তার নাম দিলেন 'ইবরাহীম' এবং তাকে ‘তাহনিক’ (খেজুর চিবিয়ে তার মুখে দিলেন) করালেন, তার বরকতের জন্য দোয়া করে দিলেন এবং আমার কাছে তাকে ফিরিয়ে দিলেন।’[হাদীসটি বুখারী (৫১৫০) ও মুসলিম (২১৪৫) বর্ণনা করেন]
তাহনিক হচ্ছে শিশু জন্মের পর তার মুখে খেজুর অথবা মধুর মতো মিষ্টি কিছু প্রদান করা।
খ. জন্মের প্রথম অথবা সপ্তম দিনে সন্তানের নাম রাখা জায়েয।
- আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘আজ রাতে আমার একটি পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছে। আমি আমার পিতা ইব্রাহীমের নামে তার নাম রেখেছি 'ইব্রাহীম'।...’ [হাদীসটি মুসলিম (৩১২৬) বর্ণনা করেন]
- আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান ও হোসাইনের জন্য সপ্তম দিনে আকীকা করেছেন এবং তাদের নাম রেখেছেন।[হাদীসটি ইবনে হিব্বান (১২/১২৭) ও হাকেম (৪/২৬৪) বর্ণনা করেন। হাফেয ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ ফাতহুল বারী গ্রন্থে (৯/৫৮৯) হাদীসটিকে সহিহ বলে গণ্য করেছেন]
গ. আকীকা ও খতনা
১. সালমান ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “প্রত্যেক শিশুর পক্ষেই আকীকা করা দরকার। অতএব তোমরা তার পক্ষ থেকে রক্ত প্রবাহিত কর (পশু যবেহ কর) এবং তার থেকে কষ্টদায়ক বস্তু (যেমন: চুল) দূর কর।”[হাদীসটি তিরমিযী (১৫১৫), নাসাঈ (৪২১৪), আবু দাউদ (২৮৩৯) ও ইবনে মাজাহ (৩১৬৪) বর্ণনা করেন। উক্ত হাদীসকে শাইখ আলবানী ‘ইরওয়াউল গালীল’ গ্রন্থে (৪/৩৯৬) সহিহ বলে গণ্য করেন]
২. সামুরা ইবনে জুন্দুব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “সকল শিশুই তার আকীকার সাথে বন্ধক (দায়বদ্ধ) অবস্থায় থাকে। জন্মগ্রহণ করার সপ্তম দিনে তার পক্ষে যবেহ করতে হয়, তার নাম রাখতে হয় এবং তার মাথার চুল কামিয়ে ফেলতে হয়।”[হাদীসটি তিরমিযী (১৫২২), নাসাঈ (৪২২০) ও আবু দাউদ (২৮৩৮) বর্ণনা করেন। শাইখ আলবানী ‘ইরওয়াউল গালীল’ গ্রন্থে (৪/৩৮৫) হাদীসটিকে সহিহ বলে গণ্য করেন]
ইমাম ইবনুল কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ যা বলেছেন তার সারকথা হলো:
আকীকার অন্যতম ফায়দা হচ্ছে এটি এমন একটি কুরবানী, যার মাধ্যমে নবজাতক শিশুকে এই দুনিয়ায় আগমনের পর পরই আল্লাহর সান্নিধ্যে আনা হয়।
এর অন্যতম ফায়দা হচ্ছে এটি নবজাতকের জন্য একটি মুক্তিপণ। শিশুর আকীকা তার জন্য মুক্তিপণস্বরূপ, যাতে সে তার পিতা-মাতার জন্য সুপারিশ করতে পারে।
এর আরো একটি ফায়দা হচ্ছে এটি একটি কুরবানী, যার মাধ্যমে নবজাতকের মুক্তিপণ প্রদান করা হয়, যেমন আল্লাহ ইসমাইল আলাইহিস সালামকে একটি ভেড়ার মাধ্যমে মুক্তিপণ দিয়েছিলেন।[তুহফাতুল মাউলূদ (পৃ. ৬৯)]
সম্ভবতঃ আকীকার অন্যতম আরেকটি উপকারিতা হলো ওলীমায় আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধব জমায়েত হওয়া।
গ. অন্যদিকে খতনা স্বভাবজাত সুন্নাহর অন্তর্গত। এটি শিশুর জন্য একটি ওয়াজিব আমল। কেননা এটি পবিত্রতার সাথে জড়িত; যা নামাজ বিশুদ্ধ হওয়ার অন্যতম শর্ত।
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: ‘পাঁচটি কাজ সহজাত সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত: খতনা করা, লজ্জাস্থানের আশেপাশের চুল কামানো, বগলের নিচের চুল উপড়ে ফেলা, নখ কাটা এবং মোচ খাট করা।’[হাদীসটি বুখারী (৫৫৫০) ও মুসলিম (২৫৭) বর্ণনা করেন]
তিন:
আলেমরা নবজাতক সংক্রান্ত সুন্নাহর মাঝে ডান কানে আযান দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে থাকেন। ফলে সে দুনিয়াতে আসার পরে সর্বপ্রথম তাওহীদের বাণী শুনে থাকবে। এই কাজটির বিপুল ও বরকতময় প্রভাব রয়েছে। অন্যদিকে বাম কানে ইকামত দেওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত নয়। [দেখুন: আস-সিলসিলাতুদ দঈফা: (১/৪৯১)]
চার:
শিশুর মাথা মুণ্ডন করা ও জাফরান দিয়ে মাথায় তেল মালিশ করার ডাক্তারি উপকারিতা প্রমাণিত। এরপর চুলের ওজন পরিমাণ স্বর্ণ অথবা রৌপ্য দান করতে হবে। এক্ষেত্রে মুণ্ডনকৃত চুল পরিমাপ করা শর্ত নয়। যদি এই কাজটি করা কঠিন হয়ে যায় তাহলে মুণ্ডনকৃত চুলের অনুমিত একটি পরিমাণ ধরে সে পরিমাণ স্বর্ণ অথবা রৌপ্যের মূল্য মুদ্রায় নির্ধারণ করে কল্যাণকর খাতে দান করতে হবে।
আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে ও আমাদের সন্তানদেরকে সকল প্রকার অপছন্দনীয় বিষয় থেকে রক্ষা করেন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের ক্ষেত্রে আমাদেরকে নিরাপত্তা দান করেন। আমাদের নবী মুহাম্মাদের উপর আল্লাহর দরূদ অবতীর্ণ হোক।