রঙের ভিত্তিতে পোশাকের হুকুম

প্রশ্ন: 72878

হাদীসে উসফুর (কুসুম)-এ রঞ্জিত কাপড় দ্বারা উদ্দেশ্য কী? সবুজ অথবা ধূসরাভ হলুদ রঙের পোশাক কি পরা যাবে? নাকি এগুলো পরা মাকরুহ (অপছন্দনীয়) হওয়ার ব্যাপারে কোনো প্রমাণ আছে?

উত্তর

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, দুরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূলের প্রতি। পর সমাচার:

এক:

পোশাকের মূল বিধান হচ্ছে বৈধতা। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন:

هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُم مَّا فِي الأَرْضِ جَمِيعاً ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاء فَسَوَّاهُنَّ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

“তিনি সেই মহান সত্তা যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন; তারপর আসমানের ঊর্ধ্বে উঠেছেন এবং আসমানকে সুষমভাবে সাত আসমানে সৃষ্টি করেছেন। তিনি সবকিছু ভালোভাবে জানেন।”[সূরা বাকারা: ২৯]

আল্লাহ তাআলা আমাদের পরিধানের জন্য যা সৃষ্টি করেছেন তা উল্লেখ করে তিনি আমাদেরকে তাঁর নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন:

يَا بَنِي آدَمَ قَدْ أَنزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاساً يُوَارِي سَوْءَاتِكُمْ وَرِيشاً وَلِبَاسُ التَّقْوَىَ ذَلِكَ خَيْرٌ ذَلِكَ مِنْ آيَاتِ اللّهِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ

“হে আদমের সন্তানেরা! আমি তোমাদেরকে লজ্জা নিবারণ ও সাজসজ্জার জন্য পোশাক দিয়েছি। আর তাকওয়ার পোশাকই সর্বোত্তম। এগুলো আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্গত; যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।”[সূরা আ’রাফ: ২৬]

সুতরাং কেউ যদি কোন ধরন বা রঙের পোশাক হারাম বলে দাবি করে তাকে এর পক্ষে সুস্পষ্ট দলীল পেশ করতে হবে।

দুই:

পুরুষদের জন্য তিন রঙের পোশাক পরার ব্যাপারে আলেমরা মতভেদ করেছেন:

১- টকটকে লাল রঙের পোশাক, যার সাথে অন্য কোনো রং মিশ্রিত হয়নি। যে লাল রঙের পোশাকের সাথে অন্য রং মিশ্রিত হয়েছে তা পরা জায়েয হওয়ার ব্যাপারে সবাই একমত। এর বিবরণ ইতঃপূর্বে (8341) নং প্রশ্নের উত্তরে প্রদান করা হয়েছে।

২- উসফুর দ্বারা রঞ্জিত। উসফুর বা কুসুম হচ্ছে একটি পরিচিত উদ্ভিদ, যা লাল রঙে রঞ্জিত করে। কুসুম ছাড়া অন্য কোনো কিছু থেকে লাল রঙে রঞ্জিত হলে সেটি পূর্বের প্রকারের অন্তর্ভুক্ত হবে।

৩- জাফরান দ্বারা রঞ্জিত। এটি হচ্ছে এমন উদ্ভিদ যা হলুদ রং প্রদান করে। জাফরান ছাড়া অন্য কোনোভাবে হলুদ রঙে রঞ্জিত হলে তা পরার বৈধতার ব্যাপারে আলেমরা একমত।

উসফুর বা কুসুম দ্বারা রঞ্জিত পোশাক পরার হুকুম প্রসঙ্গে আলেমদের তিনটি অভিমত রয়েছে:

প্রথম মত: এমন পোশাক পরা হারাম। এটি যাহেরী মাযহাব এবং ইবনুল কাইয়িমের মত।

তাদের দলীল হচ্ছে মুসলিমে (২০৭৭) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস থেকে বর্ণিত হাদীস, তিনি বলেন: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার পরনে দুটি কুসুমের রঙে রঞ্জিত কাপড় দেখে বললেন: এগুলো কাফেরদের পোশাক। তুমি এগুলো পরবে না।’ অন্য বর্ণনায়: ‘তোমার মা কি তোমাকে এটা পরতে বলেছে? আমি বললাম: আমি কি এগুলো ধুয়ে ফেলব? তিনি বললেন: তুমি এগুলো পুড়িয়ে ফেলো।’

আরো একটি দলীল হচ্ছে মুসলিমে (২০৭৮) আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীস, তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম 'মুআসফার' বা কুসুম দ্বারা রঞ্জিত কাপড় পরতে নিষেধ করেছেন।”

দ্বিতীয় মত: এমন পোশাক পরা মাকরূহ। এটি হানাফী এবং মালেকীদের মত। হাম্বলীদের কাছেও এটি নির্ভরযোগ্য মত। তারা বলেন: পূর্বের নিষেধাজ্ঞাকে অপছন্দনীয়তার অর্থে নিতে হবে। কারণ বারা ইবনে আযিব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: ‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লাল হুল্লা (একই রঙের চাদর ও লুঙ্গি) পরিহিত অবস্থায় দেখেছি।’[হাদীসটি বুখারী (৩৫৫১) ও মুসলিম (২৩৩৭) বর্ণনা করেন]

তৃতীয় মত: এমন পোশাক পরা জায়েয। এটি শাফেয়ীদের মত।

[আল-মাজমূ (৪/৪৫০), আল-মুগনী (২/২৯৯), আল-মুহাল্লা (৪/৬৯), তাহযীবু সুনানি আবি দাউদ (১১/১১৭), হাশিয়াতু ইবন আবিদীন (৫/২২৮)]

আল্লাহই সর্বজ্ঞ; তবে আমার কাছে হারাম হওয়ার মতটি অগ্রগণ্য। কারণ নিষেধাজ্ঞা মূলতঃ হারাম করার জন্য হয়ে থাকে। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের লাল রঙের পোশাক পরিধান করার অর্থ এই নয় যে এটি কুসুমের রঙে রঞ্জিত হওয়ার কারণে লাল। বরং সেটি কুসুম ছাড়া অন্য কিছুর দ্বারা লাল রঙে রঞ্জিত ছিল।[দেখুন, মা’আলেমুস সুনান (৪/১৭৯)]

অন্যদিকে জাফরানের রঙে রঞ্জিত পোশাক পরার ব্যাপারে আলেমদের তিনটি মত রয়েছে। সবচেয়ে সঠিক মত হচ্ছে শাফেয়ীদের মত এবং তা হাম্বলীদেরও একটি বর্ণনা। সেটি হচ্ছে: পুরুষের জন্য জাফরানের রঙে রঞ্জিত পোশাক পরা হারাম। এর প্রমাণ হচ্ছে আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস, তিনি বলেন: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষকে জাফরানের রঙের পোশাক পরতে নিষেধ করেছেন।’[হাদীসটি বুখারী (৫৮৪৬) ও মুসলিম (২১০১) বর্ণনা করেন]

শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘সঠিক মত হচ্ছে পুরুষের জন্য কুসুমের রঙে রঞ্জিত পোশাক পরা হারাম। আর জাফরানের রঙে রঞ্জিত পোশাকের হুকুমও অনুরূপ।’[সমাপ্ত][আশ-শারহুল মুমতি’ (২/২১৮)]

[দেখুন: আত-তামহীদ (২/১৮০), আল-ইনসাফ (১/৪৮১), আল-মুহাল্লা (৪/৭৬), আল-মাজমূ (৪/৪৪৯), হাশিয়াতু ইবনে আবিদীন (৫/২২৮), আল-মুগনী (২/২৯৯)]

তিন:

এই রঙগুলো ছাড়া অন্যান্য রঙের পোশাক পরার বৈধতার ব্যাপারে কোনো আলেম দ্বিমত করেননি। বরং তারা এ ব্যাপারে ঐকমত্যের কথা বর্ণনা করেছেন। যথা:

ইমাম নববী তার ‘আল-মাজমূ’ (৪/৩৩৭) গ্রন্থে বলেন:

‘সাদা, লাল, হলুদ, সবুজ ও ডোরাকাটাসহ অন্যান্য রঙের পোশাক পরা জায়েয। এ ব্যাপারে কোনো মতভেদ নেই। এগুলোর কোনোটিতে অপছন্দনীয় কিছু নেই।’[সমাপ্ত]

আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা (৬/১৩২-১৩৬) গ্রন্থে এসেছে:

‘ফকীহরা একমত যে সাদা রঙের পোশাক পরিধান করা মুস্তাহাব। ... ফকীহরা হলুদ রঙের পোশাক পরার বৈধতার ব্যাপারে একমত; যদি সেটি কুসুম বা জাফরানের রঙে রঞ্জিত না হয়।’[সমাপ্ত]

এছাড়া নারী যে রঙের ইচ্ছা সে রঙের পোশাক পরতে পারবে; যতক্ষণ সে এই পোশাকের দ্বারা বেগানা পুরুষদের সামনে নিজেকে প্রকাশ না করে। যারা কুসুম ও জাফরান রঙে রঞ্জিত পোশাক হারাম হওয়ার কথা বলেছেন তারা সেটিকে পুরুষদের জন্য হারাম বলেছেন।

ইবনে আব্দুল বার আত-তামহীদ গ্রন্থে (১৬/১২৩) বলেন: ‘নারীদের জন্য কুসুম রঙে রঞ্জিত পোশাক পরা বৈধ হওয়ার ব্যাপারে আলেমদের মতভেদ নেই। সেটা 'মুফাদ্দাম' হোক, 'মুওয়াররাদ' হোক বা 'মুমাশশাক' হোক। মুফাদ্দাম হলো: যা টকটকে লাল রঙে রঞ্জিত। 'মুওয়াররাদ' হলো: যা তার চেয়ে কম লাল। আর 'মুমাশশাক' হলো: লাল রঙের মাটি দ্বারা রঞ্জিত পোশাক।’[সমাপ্ত]

সারকথা হলো: সবুজ ও ধূসরাভ-হলুদ রঙের পোশাক পরিধান করা বৈধ। এগুলো হারাম হওয়ার ব্যাপারে কোনো কিছু বর্ণিত হয়নি। তবে যদি কুসুম বা জাফরানে রঞ্জিত হওয়ার কারণে এর রং এমন হয়ে যায় তখন সেটি কেবল পুরুষদের জন্য পরিধান করা হারাম হবে। আলেমদের অভিমতসমূহের এই অভিমত অগ্রগণ্য।

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

সূত্র

সূত্র

ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

at email

নিউজলেটার

ওয়েবসাইটের ইমেইল ভিত্তিক নিউজলেটারে সাবস্ক্রাইব করুন

phone

ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব অ্যাপ্লিকেশন

কন্টেন্টে আরও দ্রুত পৌঁছতে ও ইন্টারনেট ছাড়া ব্রাউজ করতে

download iosdownload android