অ্যালকোহলযুক্ত খাদ্যদ্রব্য ও প্রসাধনী সামগ্রী ব্যবহারের হুকুম

প্রশ্ন: 59899

আমি ভিয়েনার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ফার্মেসী অনুষদে পড়তে গিয়ে আমি আবিষ্কার করেছি যে অধিকাংশ উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যে সামান্য পরিমাণ অ্যালকোহল যুক্ত করা হয়। একাধিক উপাদানের মিশ্রণ ঘটানো, উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণ করা অথবা সেটিকে আরো ঘন করার জন্য এমনটি করা হয়। এই উপাদানগুলো হলো: GLYCEROL, SORBIT, XYLIT, MALTIT, VANILIN, TRIACETIN, AGAR AGAR, PETKIN। অন্য একটি প্রশ্ন হলো: ক্রীম, পারফিউম কিংবা সাধারণভাবে প্রসাধনী সামগ্রীতে অ্যালকোহল ব্যবহার করার হুকুম কী?

উত্তর

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, দুরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূলের প্রতি। পর সমাচার:

এক:

অ্যালকোহল অন্যতম নেশা সৃষ্টিকারী দ্রব্য। সকল নেশা সৃষ্টিকারী দ্রব্যই মদ। মদ হারাম। এখানে অ্যালকোহলের সাথে দুটি বিষয় সম্পৃক্ত:

এক: এটি কি অপবিত্র; নাকি অপবিত্র নয়?

দুই: খাদ্যদ্রব্য ও ঔষধ-পথ্যের সাথে এর মিশ্রণ ঘটালে এর কি কোনো প্রভাব আছে?

প্রথম বিষয়টি হলো: অধিকাংশ আলেম মনে করেন মদের অপবিত্রতা বস্তুগত। কিন্তু সঠিক মত হলো এটি বস্তগতভাবে অপবিত্র নয়। বরং এর অপবিত্রতা অবস্তুগত বা ভাবগত।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো: যদি অ্যালকোহল ঔষধ ও খাবারের সাথে মেশানো হয় তাহলে হয়তো এর প্রভাব সুস্পষ্ট হবে কিংবা সুস্পষ্ট হবে না। যদি প্রভাব সুস্পষ্ট হয়, তাহলে মেশানো হারাম। এমন খাদ্য বা ঔষধ খাওয়া বা পান করা হারাম হবে।

আর যদি ঐ সমস্ত খাদ্যদ্রব্য বা ঔষধে অ্যালকোহলের কোনো প্রভাব না থাকে, তাহলে খাওয়া কিংবা পান করা জায়েয হবে। সরাসরি অ্যালকোহল গ্রহণ করা, আর অন্য কিছুর সাথে মিশ্রণের মাধ্যমে ব্যবহার করার মাঝে পার্থক্য রয়েছে। শুধু অ্যালকোহল গ্রহণ করা নাজায়েয; এমনকি যদি পরিমাণে কমও হয়। আর যদি অন্য কিছুর সাথে মেশানো হয় তাহলে উপরোক্ত বিবরণ অনুযায়ী এর হুকুম।

উপরোক্ত বিবরণ সম্বলিত শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ আল-উছাইমীনের ফতোয়া নিম্নরূপ:

শাইখ রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘এটি সুবিদিত যে, অ্যালকোহল নেশা সৃষ্টিকারী উপাদান। সুতরাং এটি মদ। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: "প্রত্যেক নেশাকর দ্রব্য হারাম"। অন্য বর্ণনায় আছে: "প্রত্যেক নেশাকর দ্রব্য মদ"। সুতরাং অ্যালকোহল যদি কোনো কিছুর সাথে মিশে নিঃশেষ হয়ে না যায় তাহলে এটি হারাম হয়ে যাবে। কারণ এই মিশ্রণ এতে প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু যদি অ্যালকোহল এতে মিশে যায় এবং কোনো ধরনের চিহ্ন প্রকাশ না পায়, তাহলে হারাম হবে না। কারণ আলেমরা এ ব্যাপারে একমত যে, পানিতে যদি নাপাকি মিশ্রিত হয়ে তাতে পরিবর্তন না ঘটায় তাহলে পানি পবিত্র থাকে। অ্যালকোহল ও মিশ্রিত বস্তুর আনুপাতিক হার বড় হতে পারে; আবার ছোট হতে পারে। অর্থাৎ অ্যালকোহল শক্তিশালী হতে পারে, ফলে অল্প পরিমাণও মিশ্রিত বস্তুর উপর প্রভাবশালী হবে। আবার অ্যালকোহল দুর্বল হতে পারে। ফলে বেশি পরিমাণও প্রভাব সৃষ্টি না করতে পারে। বিষয়টি নির্ভর করবে প্রভাবের উপর।

এখানে দুটি মাসয়ালা রয়েছে:

এক: মদ কি বস্তুগত নাপাকি? অর্থাৎ এর থেকে পবিত্র থাকা, কাপড়ে লাগলে সেটি ধৌত করা, গায়ে লাগলে ধুয়ে ফেলা এবং পাত্রে লাগলে সেটি ধুয়ে ফেলা ওয়াজিব; নাকি ওয়াজিব নয়? অধিকাংশ মাযহাবের আলেমগণ মনে করেন যে মদ বস্তুগতভাবে নাপাক। শরীর, জামা-কাপড়, পাত্র, বিছানা কিংবা অন্য যে কোনো কিছুতে লাগলে সেটি ধুয়ে ফেলা ওয়াজিব। যেমনিভাবে পেশাব ও পায়খানা কোথাও লাগলে সেটি ধুয়ে ফেলা ওয়াজিব। এক্ষেত্রে তারা আল্লাহর এই বাণী দিয়ে দলীল পেশ করেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ

“হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, মূর্তি, ভাগ্য নির্ণয়ের তীর এগুলো رِجْس (নাপাক), শয়তানী কাজ।”

আয়াতে رِجْس মানে যে নাপাক এর সপক্ষে প্রমাণ হলো আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী:

قُلْ لا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّماً عَلَى طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَنْ يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَماً مَسْفُوحاً أَوْ لَحْمَ خِنْزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ

“বলো: আমার কাছে যে বিধান পাঠানো হয়েছে তাতে হারাম বলে কিছু পাই না এগুলো ছাড়া: মৃত প্রাণী বা প্রবাহিত রক্ত অথবা শূকরের মাংস; যা رِجْس (তথা নাপাক)।”

এছাড়া তারা আবু সা’লাবা আল-খুশানীর হাদীস দিয়ে দলীল পেশ করে, যিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাফেরদের পাত্রে খাওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন: “তোমরা এতে খেয়ো না। তবে তোমরা যদি এছাড়া অন্য কিছু না পাও তাহলে এগুলো ধুয়ে নিয়ে এগুলোতে খেয়ো।”

এগুলোতে খাওয়ার ব্যাপারে নিষেধ করার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে তারা এতে মদ, শূকরের গোশত এবং অনুরূপ কিছু এগুলোতে রাখত।

কিন্তু এই বিষয়ে দ্বিতীয় মত হলো মদ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা বস্তুগত নাপাকি নয়। এই মতের পক্ষে দলীল প্রদান করা হয়েছে যে, যে কোনো বস্তুর মূল অবস্থা হলো পবিত্রতা। কোনো বস্তু হারাম হলেই সেটি নাপাক হয়ে যায় না। নিঃসন্দেহে বিষ হারাম। কিন্তু এটি নাপাক নয়। তারা আরও বলেন: শরয়ী মূলনীতি হচ্ছে: প্রত্যেক নাপাক হারাম; কিন্তু সকল হারাম নাপাক নয়। সুতরাং মদ হারাম হলেও নাপাক নয়, যতক্ষণ না এটি নাপাক হওয়ার পক্ষে প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা আরো দলিল দিয়েছেন যে, মদ হারাম ঘোষণা করার পর মুসলিমরা বাজারে মদ ঢেলে ফেলে দেয়; কিন্তু পাত্রগুলো তারা ধৌত করেনি। বাজারে মদ ফেলে দেওয়া প্রমাণ করে যে মদ নাপাক নয়। কারণ কোন ব্যক্তির জন্য মুসলিমদের বাজারে নাপাকি ঢালা জায়েয নেই। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসের কারণেও। তিনি বলেছিলেন: “তোমরা দুটি অভিশপ্ত কাজ থেকে দূরে থাকবে।” সাহাবীরা বলল: ‘হে আল্লাহর রাসূল, সেই দু'টি কী?’ তিনি বললেন: “মানুষের যাতায়াতের পথে অথবা (বিশ্রাম নেওয়ার) ছায়া বিশিষ্ট স্থানে পেশাব-পায়খানা করা।” অধিকন্তু তারা এই পাত্রগুলো ধৌত করেনি। যদি নাপাক হত, তাহলে পাত্রগুলো ধৌত করা আবশ্যক হত। এই মতের পক্ষে সহিহ মুসলিমের হাদীস দিয়েও প্রমাণ দেওয়া হয়। এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক মশক মদ উপহার দিল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জানালেন: মদকে হারাম করা হয়েছে?’ তখন একজন সাহাবী মশকওয়ালার সাথে চুপেচুপে কিছু বলল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন: ‘তুমি চুপেচুপে তাকে কী বললে?’ সে বলল: আমি তাকে বলেছি: তুমি এটি বিক্রি করে দাও। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিক্রি করতে নিষেধ করলেন এবং বললেন: “আল্লাহ যখন কোনো কিছু হারাম করেন তখন এর মূল্যও হারাম করেন।” হাদীসটি এভাবে কিংবা এর কাছাকাছি অর্থে বর্ণিত হয়েছে। এরপর লোকটি মশকের মুখ খুলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে মদ ফেলে দিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মশক ধোয়ার নির্দেশ দেননি। যদি মদ নাপাক হত, তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জানিয়ে দিতেন যে মশকটি নাপাক এবং তাকে সেটি ধোয়ার নির্দেশ দিতেন।

আর মদকে বস্তুগতভাবে নাপাক গণ্যকারী ব্যক্তিরা যে আয়াতটি দিয়ে দলিল দেন: “হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, মূর্তি, ভাগ্য নির্ণয়ের তীর এগুলো رِجْس (নাপাক), শয়তানী কাজ।” এখানে আল্লাহ 'নাপক' কে কর্ম বলে বিশেষিত করে উল্লেখ করেছেন যে, এটি 'কর্মগত নাপাক'। আয়াতে বলেছেন: "এগুলো رِجْس (নাপাক), শয়তানী কাজ"। তিনি এটাকে বস্তুগত নাপাক গণ্য করেননি। এর প্রমাণ হলো জুয়া, মূর্তি ও ভাগ্য নির্ণয়ের তীর নাপাক বস্তু নয়। এই বস্তুগুলো নাপাক হওয়ার ব্যাপারে উদ্ধৃত বিধেয় এবং মদ নাপাক হওয়ার ব্যাপারে উদ্ধৃত বিধেয় অভিন্ন বিধেয়। তাই কোনোভাবে অভিন্ন বিধেয় দিয়ে দুটো উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে ভিন্ন দুটো অর্থ গ্রহণ করা জায়েয নয়; যতক্ষণ না ভিন্ন কোনো দলীল ভিন্ন কোন অর্থ নির্দিষ্ট না করে।

আর আবু সা’লাবা আল-খুশানীর হাদীসে কাফেরদের পাত্র নাপাক হওয়ার কারণে ধৌত করার আদেশ দেয়া হয়নি। বরং এমন সম্ভাবনা থাকতে পারে যে ধৌত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে করে কাফেরদের পাত্র ব্যবহার থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ও দূরে থাকা সম্ভব হয়। কারণ তাদের পাত্র ব্যবহার করা তাদের সংস্পর্শে আসা ও তাদের কাছাকাছি আসার দিকে ধাবিত করবে। আর এটা জ্ঞাত বিষয় যে সম্ভাবনা দিয়ে নাপাকি সাব্যস্ত করা যায় না।

যাইহোক, এটি হচ্ছে অ্যালকোহল সম্পর্কে এই প্রশ্নের উত্তরের প্রথম অংশ। যেহেতু প্রমাণিত হলো যে মদ বস্তুগতভাবে নাপাক নয়, সেহেতু অ্যালকোহলও বস্তুগতভাবে নাপাক নয়। তাই অ্যালকোহল এর পবিত্রতার উপর বহাল থাকবে।

আর দ্বিতীয় বিষয়টি হলো: যদি এটি নিশ্চিত হয় যে, এই সুগন্ধিগুলোতে অ্যালকোহল আছে এবং পরিমাণে বেশি হওয়ার কারণে সেটি প্রভাবশালী তাহলে কি এগুলো পান করা ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে? এর উত্তরে বলা হবে: আল্লাহ তাআলা বলেন: “তোমরা এ সব থেকে দূরে থাকো।” আল্লাহর এই বাণী সকল প্রকার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাধারণ। অর্থাৎ আমরা খাওয়া, পান করা, তেল হিসেবে ব্যবহার করা কিংবা অন্য সকল ক্ষেত্রে এগুলো পরিহার করব। নিঃসন্দেহে এটি বেশি নিরাপদ। কিন্তু পান করা ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা নির্দিষ্ট হয় না। কারণ আল্লাহ এই পরিহারের আদেশ দেওয়ার পিছনে কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন: “বস্তুত শয়তান মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে বিরত রাখতে চায়। অতএব তোমরা কি (এসব) পরিহার করবে না?” আর এই অবস্থা পান করা ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে ঘটে না। সুতরাং আল্লাহভীতির জায়গা থেকে এই সমস্ত সুগন্ধি পরিহার করা উচিত। তবে নিশ্চিতভাবে এগুলোকে হারাম বলা সম্ভব নয়।...” [সমাপ্ত][ফাতাওয়া নূরুন-আলাদ্দারব, শাইখের ওয়েবসাইট থেকে গৃহীত]

তিন:

অন্যদিকে প্রসাধনী সামগ্রীর উপাদানের বিধান সম্পর্কে জানতে 20226 26799  নং প্রশ্নের উত্তর দেখুন।

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

সূত্র

সূত্র

ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

answer

সংশ্লিষ্ট প্রশ্নোত্তরসমূহ

at email

নিউজলেটার

ওয়েবসাইটের ইমেইল ভিত্তিক নিউজলেটারে সাবস্ক্রাইব করুন

phone

ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব অ্যাপ্লিকেশন

কন্টেন্টে আরও দ্রুত পৌঁছতে ও ইন্টারনেট ছাড়া ব্রাউজ করতে

download iosdownload android