শাইখ ইবনে উছাইমীন আশ-শারহুল মুমতি’ গ্রন্থে বলেন:
ইমামের সাথে মুক্তাদীর চারটি অবস্থা:
১. ইমামের আগে করা।
২. ইমাম থেকে পিছিয়ে থাকা।
৩. ইমামের সাথে সাথে করা।
৪. ইমামের পরপর করা।
এক: ইমামের আগে করা:
অর্থাৎ মুক্তাদী নামাযের কোনো রুকনের ক্ষেত্রে ইমামের তুলনায় এগিয়ে গিয়ে করা। যেমন: ইমামের আগে সিজদা দেয়া কিংবা সিজদা থেকে ওঠা কিংবা রুকু দেয়া কিংবা রুকু থেকে ওঠা। এমনটি করা হারাম। এর দলীল হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “তোমরা রুকু করো না যতক্ষণ না ইমাম রুকুতে যায়। তোমরা সিজদা করো না যতক্ষণ না ইমাম সিজদায় যায়।” আর নিষেধাজ্ঞার মূল হুকুম হলো হারাম হওয়া। বরং কেউ যদি বলে: এটি কবীরা গুনাহ তাহলে সেটি অত্যুক্তি হবে না। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি ইমামের আগে মাথা তোলে তার কি ভয় হয় না যে, মহান আল্লাহ তার মাথা গাধার মাথায় পরিবর্তন করে দিবেন অথবা তার আকৃতিকে গাধার আকৃতি বানিয়ে দিবেন!” এটি শাস্তির হুমকি। আর শাস্তির হুমকি দেয়া কবীরা গুনাহ হওয়ার আলামত।
যে ব্যক্তি নামাযের কার্যাবলি ইমামের আগে করে তার নামাযের হুকুম:
যদি মুক্তাদী জেনে-বুঝে স্মরণ থাকা অবস্থায় ইমামের আগে কোনো আমল করে তাহলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে। আর যদি না জেনে কিংবা ভুলে গিয়ে করে তাহলে তার নামায সঠিক হবে। তবে যদি ইমাম তাকে সংশ্লিষ্ট আমলে পাওয়ার আগে তার ওজর দূর হয়ে যায় তাহলে তার জন্য ফিরে যাওয়া ও ইমামের আগে কৃত আমলটি ইমামের অনুসরণে করা আবশ্যক হবে। যদি সে জেনে ও স্মরণে থাকা সত্ত্বেও এমনটি না করে, তাহলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে। অন্যথায় বাতিল হবে না।
দুই: ইমাম থেকে পিছিয়ে থাকা:
ইমামের তুলনায় আমলে পিছিয়ে থাকা দুই প্রকার:
১. ওজরের কারণে পিছিয়ে থাকা।
২. ওজর ছাড়া পিছিয়ে থাকা।
প্রথম প্রকার হলো: ওজরের কারণে পিছিয়ে থাকা।
এমন ব্যক্তি যে অংশটুকুতে পিছিয়ে ছিল সে অংশ সম্পন্ন করে ইমামের অনুসরণ করবে; এতে কোনো সমস্যা নেই। এমনকি যদি পূর্ণ এক বা দুই রুকনও হয়ে থাকে। যদি কোনো ব্যক্তি ভুলে যায় বা উদাসীন হয়ে পড়ে কিংবা ইমামের আওয়াজ শুনতে না পায় এবং ইমাম এক বা দুই রুকন এগিয়ে যায়, তাহলে সে যেগুলোতে পিছিয়ে পড়েছে সেগুলো আদায় করে ইমামের অনুসরণ করবে। তবে যদি ইমাম সে যেই আমলে আছে সেই আমলে চলে আসে তাহলে সে পিছিয়ে পড়া আমলগুলো না করে বরং ইমামের সাথে থাকবে। এভাবে ইমামের দুই রাকাত থেকে তার এক রাকাত নামায শুদ্ধ হবে; অর্থাৎ যে রাকাতে সে পিছিয়ে পড়েছিল সেই রাকাত এবং ইমাম যেই রাকাতে পৌঁছেছে সেই রাকাত মিলে। এর উদাহরণ হলো:
এক লোক ইমামের সাথে নামায পড়ছে। ইমাম রুকু দিয়েছে, রুকু থেকে উঠেছে, সিজদা দিয়েছে, বসেছে, দ্বিতীয় সিজদা দিয়ে আবার দাঁড়িয়েছে, কিন্তু লোকটি কেবল দ্বিতীয় রাকাতে এসে ইমামের তাকবীর ধ্বনি শুনতে পেয়েছে। যেমন বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে এমনটি হতে পারে। আমরা ধরে নিই এটি জুমার নামাযে ঘটেছে। সে ইমামের সূরা ফাতিহার তেলাওয়াত শুনতেছিল এর মধ্যে বিদ্যুত চলে যায়। ইমাম প্রথম রাকাত শেষ করে দাঁড়িয়ে গেল। এদিকে মুক্তাদী ভাবছে ইমাম প্রথম রাকাতের রুকু এখনো দেয়নি। মুক্তাদী ইমামকে সূরা গাশিয়া পড়তে শুনল।
আমরা বলব: আপনি ইমামের সাথেই থাকবেন। ইমামের দ্বিতীয় রাকাত আপনার প্রথম রাকাতের বাকি অংশ হিসেবে গণ্য হবে। ইমাম যখন সালাম ফিরাবেন তখন আপনি দ্বিতীয় রাকাত সম্পন্ন করবেন। আলেমরা বলেন: এভাবে মুক্তাদীর এক রাকাত হবে যা ইমামের দুই রাকাত দ্বারা গঠিত। কারণ সে ইমামকে প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় রাকাতে অনুসরণ করেছে। আর যদি ইমাম তার স্থানে পৌঁছানোর আগে সে নিজের পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি বুঝতে পারে তাহলে সে সেই আমলগুলো আদায় করে ইমামের অনুসরণ করবে। এর উদাহরণ হলো:
এক লোক ইমামের সাথে নামাযে দাঁড়িয়েছে। ইমাম রুকু দিয়েছে কিন্তু সে শুনতে পায়নি। তারপর যখন ইমাম ‘সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ’ বলেছে তখন সেটা শুনতে পেয়েছে। এমন ব্যক্তিকে আমরা বলব: আপনি রুকু দিয়ে রুকু থেকে উঠুন এবং ইমামের অনুসরণ করুন। আপনি রাকাতটি পেয়েছেন বলে গণ্য হবে। কারণ এখানে আপনি ওজরের কারণে পিছিয়ে পড়েছেন।
দ্বিতীয় প্রকার হলো ওজর ছাড়া পিছিয়ে পড়া।
এটি হতে পারে কোন রুকনের মধ্যে পিছিয়ে পড়া কিংবা এক রুকন পিছিয়ে পড়া।
রুকনের মধ্যে পিছিয়ে পড়ার অর্থ হলো আপনি ইমামকে অনুসরণে পিছিয়ে পড়েছেন, কিন্তু ইমাম যেই রুকনে চলে গেছেন আপনি তাকে সেখানে গিয়ে ধরতে পারবেন। যেমন: ইমাম রুকু দিয়ে ফেলেছেন, অথচ আপনার সূরা পড়ার এক বা দুই আয়াত বাকি। আপনি দাঁড়িয়ে থাকলেন এবং সূরার বাকি অংশ শেষ করে তারপর রুকুতে গেলেন এবং ইমামকে রুকুতে পেলেন। এখানে রাকাতটি সঠিক হল। কিন্তু কাজটি সুন্নাহর খেলাফ। কারণ শরয়ি পদ্ধতি হলো ইমাম যখন রুকুতে পৌছেঁ যাবেন তখনই আপনি রুকু শুরু করে দিবেন। আপনি পিছিয়ে থাকবেন না। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “ইমাম যখন রুকুতে যাবে তখন তোমরা রুকু করো।”
আর এক রুকন পিছিয়ে পড়া বলতে উদ্দেশ্য হলো: ইমাম আপনার এক রুকন সামনে চলে যাওয়া। অর্থাৎ আপনি রুকু করার আগে তিনি রুকু করে উঠে গেছেন। ফকীহরা বলেন: যদি আপনি রুকুতে পিছিয়ে পড়েন তাহলে আপনার নামায বাতিল হয়ে যাবে, যেমনিভাবে আপনি আগে রুকুতে গেলে আপনার নামায বাতিল হয়ে যাবে। আর যদি সিজদায় যেতে বিলম্ব করেন, তাহলে ফকীহদের মতে আপনার নামায সঠিক হবে। কারণ এটি রুকু ছাড়া অন্য রুকনে পিছিয়ে পড়া।
তবে অগ্রগণ্য মত হচ্ছে: কোনো ওজর ছাড়া যদি কেউ এক রুকন পিছিয়ে যায় তাহলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে। হোক সেটা রুকু কিংবা রুকু ছাড়া অন্য কিছু। সুতরাং ইমাম যদি প্রথম সিজদা থেকে মাথা তুলে আর মুক্তাদী সিজদায় দোয়া করতে থাকে, তারপর ইমাম দ্বিতীয় সিজদায় চলে যায় তাহলে মুক্তাদীর নামায বাতিল হয়ে যাবে। কারণ মুক্তাদী এক রুকন পিছিয়ে পড়েছে। যদি ইমাম তার থেকে এক রুকন এগিয়ে যায় তাহলে অনুসরণ কোথায় হলো?
তিন: ইমামের সাথে সাথে করা:
সাথে সাথে করা কথার ক্ষেত্রে বা কাজের ক্ষেত্রে হতে পারে। তাই সাথে সাথে করা দুই প্রকার:
প্রথম প্রকার: নামাযের কথাগুলো ইমামের সাথে সাথে করা। শুধু তাকবীরে তাহরীমা ও সালামের ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনো কথা ইমামের সাথে সাথে করলে নামাযের ক্ষতি হবে না।
তাকবীরে তাহরীমা: ইমাম তাকবীরে তাহরীমা বলা শেষ করার আগে যদি আপনি তাকবীরে তাহরীমা বলেন তাহলে আপনার নামায হবে না। ইমাম তাকবীরে তাহরীমা পুরোপুরি সমাপ্ত করার পরই কেবল আপনি তাকবীরে তাহরীমা বলবেন।
আর সালামের ক্ষেত্রে সাথে সাথে করার ব্যাপারে আলেমরা বলেন: ইমামের সাথে সাথে প্রথম ও দ্বিতীয় সালাম ফেরানো মাকরূহ। তবে যদি ইমাম প্রথম সালাম ফেরানোর পরে আপনি প্রথম সালাম ফেরান এবং ইমাম দ্বিতীয় সালাম ফেরানোর পরে আপনি দ্বিতীয় সালাম ফেরান, তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু উত্তম হলো ইমাম দুই সালাম ফেরানোর পরেই কেবল আপনি সালাম ফেরাবেন।
আর বাকি কথাগুলো ইমামের সাথে একত্রে করা কিংবা আগে অথবা পরে করার মাঝে কোনো সমস্যা নেই। যদি ধরে নেওয়া হয় যে আপনি ইমামকে তাশাহ্হুদ পড়তে শুনলেন, আপনি তাশাহ্হুদ পড়তে গিয়ে তাকে ছাড়িয়ে গেলেন, এতে কোনো ক্ষতি নেই। কারণ তাকবীরে তাহরীমা আর সালাম ছাড়া অন্য কিছু আগে করে ফেললে এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব নেই এবং ক্ষতি হবে না। অনুরূপভাবে যদি আপনি যোহরের নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার ক্ষেত্রে ‘ওয়ালাদ্দাল্লীন’ পড়েন আর তিনি ‘ইয়্যাকা না’বূদূ ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাঈন’ পড়েন, তাহলেও সমস্যা নেই। কারণ ইমামের জন্য কখনো কখনো যোহর ও আসরের নামাযে মুক্তাদীকে শুনিয়ে শুনিয়ে তেলাওয়াত করা শরিয়তসম্মত; যেমনটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কখনো করতেন।
দ্বিতীয় প্রকার: নামাযের কাজগুলো ইমামের সাথে সাথে করা করা। এটি মাকরূহ।
এ প্রকারের উদাহরণত হলো: যখন ইমাম রুকুর জন্য আল্লাহু আকবার বলে মাথা নোয়ানো শুরু করবে তখন আপনি ও ইমাম একসাথে মাথা নোয়ালেন। এটি মাকরূহ। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “ইমাম যখন রুকুতে যাবে তখন তোমরা রুকু করবে। ইমাম রুকুতে না যাওয়া পর্যন্ত তোমরা রুকু করবে না।”
সিজদার ক্ষেত্রে ইমাম যখন সিজদার জন্য তাকবীর দিল তখন আপনিও সিজদা দিলেন এবং আপনি ও ইমাম একসাথে জমিনে মাথা রাখলেন। এটাও মাকরূহ। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটি করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন: “ইমাম সিজদায় না যাওয়া পর্যন্ত তোমরা সিজদা করো না।”
চার: ইমামের পরপর করা:
পরপর করাই সুন্নাহ। এর অর্থ হলো: ইমাম নামাযের কাজ শুরু করার সাথে সাথে মুক্তাদী নামাযের কাজ শুরু করা। কিন্তু সাথে সাথে নয়।
উদাহরণস্বরূপ: ইমাম রুকুতে যাওয়ার পরপর আপনি রুকুতে যাবেন, যদিও আপনি মুস্তাহাব ক্বিরাত শেষ করেননি, যদিও আপনার এক আয়াত পড়া বাকি রয়ে গেছে। কারণ এটি পূর্ণ করতে গেলে আপনি পিছিয়ে পড়বেন। এমতাবস্থায় আপনি আয়াতটি পূর্ণ করবেন না।
সিজদার ক্ষেত্রে: ইমাম সিজদা থেকে উঠে গেলে আপনি ইমামের অনুসরণে উঠে যাবেন। সিজদায় থেকে আল্লাহর কাছে দোয়া করার চেয়ে ইমামের অনুসরণ করা উত্তম। কারণ আপনার নামায ইমামের সাথে সম্পৃক্ত এবং আপনি এখন আপনার ইমামের অনুসরণ করতে আদিষ্ট।”[ঈষৎ পরিবর্তিত ও সমাপ্ত][দেখুন: আশ-শারহুল মুমতি (৪/২৭৫)]
ইমাম কোনো রুকনে পৌঁছে যাওয়ার আগে মুক্তাদী সেই রুকন শুরু করবেন না। ইমাম মাটিতে তার কপাল রাখার আগে মুক্তাদী তার পিঠ ঝোঁকানো শুরু করবে না।
আল-বারা ইবনে আযিব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: “যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ’ বলতেন তখনও আমাদের কেউ পিঠ ঝোঁকাত না যতক্ষণ না নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদায় লুটিয়ে পড়তেন। তারপরে আমরা সিজদায় লুটিয়ে পড়তাম।”[সহিহ বুখারী (৬৯০) ও সহিহ মুসলিম (৪৭৪)]