যদি আপনার কাজ দ্বারা কোনোভাবে তাদেরকে প্রতারণা অথবা চুরির কোনো রূপে সাহায্য করা হয়ে থাকে; তাহলে এই চাকুরি জায়েয নেই। কেননা আল্লাহ বলেছেন:
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلا تَعَاوَنُوا عَلَى الأِثْمِ وَالْعُدْوَانِ
“তোমরা সৎকাজ ও আল্লাহভীতিতে পরস্পর সহযোগিতা করো, পাপ ও বাড়াবাড়িতে সহযোগিতা করো না।”[সূরা মায়েদা: ২]
আর যদি আপনার কাজ সকল প্রকার হারাম থেকে দূরে থাকে এবং কোম্পানিতে অন্য কিছু ডিপার্টমেন্ট থাকে যেগুলো হারাম লেনদেন করে না; সেক্ষেত্রে আপনার জন্য পূর্বোক্ত শর্ত অনুসারে হালাল লেনদেনের ডিপার্টমেন্টে কাজ করা বৈধ হবে। সে শর্তটি হচ্ছে কোনো হারাম কাজে সাহায্য করা যাবে না।
শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ বলেন:
‘সুদী কোম্পানিতে কাজ করা জায়েয নেই। এমনকি ড্রাইভার কিংবা দারোয়ান পদে হলেও। কারণ কোনো সুদী প্রতিষ্ঠানের চাকুরিতে ঢোকার অর্থ তাতে তুষ্ট থাকা। কেউ যদি কোনো কিছুকে আপত্তিকর মনে করে থাকে তাহলে সে ঐ বস্তুর স্বার্থে কিছু করতে পারে না। যদি সে এর স্বার্থে কাজ করে থাকে তাহলে এর অর্থ সে এর প্রতি সন্তুষ্ট। আর হারামে সন্তুষ্ট ব্যক্তি পাপের ভাগীদার হবে।
অন্যদিকে যে ব্যক্তি নথিভুক্ত করা, লেখা, প্রেরণ করা, জমা রাখা বা অনুরূপ কিছু করে থাকে সে ব্যক্তি নিঃসন্দেহে হারামে লিপ্ত। জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদ দাতা, সুদ গ্রহীতা, সুদের দুই সাক্ষী ও সুদের লেখককে অভিশাপ দিয়ে বলেছেন: এরা সবাই সমান।[ফাতাওয়া ইসলামিয়্যা (২/৪০১)]
আপনার দায়িত্ব হচ্ছে হারাম ডিপার্টমেন্টগুলোতে যারা কাজ করে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এবং তাদেরকে এই সমস্ত কাজ ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দেওয়া। আপনার জন্য সম্ভব হলে আপনার উচিত হচ্ছে ক্রেতাদেরকে উপদেশ প্রদান করা এবং তাদের ক্রীত পণ্যে থাকা দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করে দেওয়া।
অন্য কোনো কাজ না থাকার দাবি সঠিক নয়। এটি শয়তানের ওয়াসওয়াসা। আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার জন্য বের হওয়ার পথ করে দেন। আর তার জন্য এমন জায়গা থেকে জীবিকার ব্যবস্থা করেন যা সে ধারণাও করে না।” কেননা বৈধ কাজের সংখ্যা অনেক। আপনার দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহর উপর নির্ভর করা, তার উপর ভরসা করা এবং হারাম পরিত্যাগ করা।
আর সন্তানরা ক্ষুধায় মারা যাবে এমন ধারণার ব্যাপারে আমরা আপনাকে প্রশ্ন করতে চাই: তারা ক্ষুধায় মারা যাক (যদি তারা মারা যাবে বলে ধরে নিই) এটা ভালো; নাকি তাদের জন্য আপনি জাহান্নামে ঢুকবেন এটা ভালো?
আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি তাদের রিযিকের দায়িত্ব নিয়েছেন, যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “আর আসমানে রয়েছে তোমাদের জীবিকা এবং তোমাদের জন্য প্রতিশ্রুত সবকিছু।” তিনি আরো বলেছেন: “অভাবের ভয়ে তোমরা সন্তানদেরকে হত্যা করো না। আমিই তাদের রুজির ব্যবস্থা করি; এবং তোমাদেরও। তাদেরকে হত্যা করা নিশ্চয়ই একটি বড় পাপ।” আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকটি মানুষের রিযিক লিখে রেখেছেন, সে তার মায়ের পেট থেকে বের হওয়ার আগেই। সুতরাং আরশের মালিকের কাছ থেকে অল্প পাবেন এমন আশঙ্কা করবেন না। বরং আপনার যে আত্মা আপনাকে খারাপ কাজের আদেশ দেয় সে আত্মার ব্যাপারে শঙ্কিত হোন। এটি আপনাকে ফিতনা ও পাপাচারের দিকে নিয়ে যাবে। স্মরণ করুন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “হারাম দ্বারা সৃষ্ট ও পরিপুষ্ট গোশতের জন্য (জাহান্নামের) আগুনই যথেষ্ট।”[হাদীসটি তিরমিযী (৬১৪) বর্ণনা করেন এবং শাইখ আলবানী সহিহুত তিরমিযীতে এটিকে হাসান বলে গণ্য করেন]
খলীফা উমর ইবনে আব্দুল আযীয রাহিমাহুল্লাহুর জীবনী থেকে আপনার জন্য নিম্নোক্ত ঘটনাবলি তুলে ধরছি:
উমর ইবনে আব্দিল আযীযের কাছে মুসলিমদের বায়তুল মালের আপেল আসলো। তার এক ছোট ছেলে একটা আপেল হাতে নিল। উমর বল প্রয়োগ করে তার কাছ থেকে সেটি কেড়ে নিলেন। ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে গেল। মা বাজারে গিয়ে তার জন্য আপেল কিনে আনল। উমর ফিরে এসে ঘরে ঢুকে আপেলের ঘ্রাণ পেয়ে বলল: ‘ফাতেমা, তুমি কি বায়তুল মাল থেকে কিছু নিয়েছ?’ সে বলল: ‘না।’ তার স্ত্রী তাকে জানাল যে সে নিজস্ব অর্থ দিয়ে সন্তানের জন্য আপেল কিনেছে।
উমর বলল: ‘আল্লাহর কসম! আমি তার হাত থেকে যখন কেড়ে নিয়েছি, তখন যেন নিজের অন্তর থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি। কিন্তু আমি মুসলিমদের বায়তুল মাল থেকে একটি আপেল সরিয়ে আল্লাহর কাছে নিজেকে লাঞ্ছিত করতে চাইনি।’[ইবনেল জাওযীর ‘মানাকিবু উমর ইবনে আব্দিল আযীয’ (পৃ. ১৯০)]
আরেকদিন এশার নামাযের পরে উমর ইবনে আব্দিল আযীয তার মেয়েদের ঘরে ঢুকলেন। তার উপস্থিতি টের পেয়ে তারা মুখে হাত দিয়ে দূরে সরে গেল। তিনি তাদের প্রতিপালনের দায়িত্বে থাকা মহিলাকে বললেন: ‘তাদের কী হয়েছে?’ সে বলল: ‘তাদের কাছে রাতে খাওয়ার মতো কিছু ছিল না; শুধু ডাল ও পেঁয়াজ ছিল। আপনি তাদের মুখ থেকে এই খাবারের দুর্গন্ধ পান এটা তারা চাইছিল না।’ উমর এ কথা শুনে কেঁদে মেয়েদেরকে বললেন: ‘হে আমার মেয়েরা, তোমরা বাহারি খাবার খাবে, আর তোমাদের বাবাকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হবে; এতে তোমাদের কী লাভ হবে?’ তার কথা শুনে মেয়েরা উঁচু আওয়াজে কাঁদল।[ড. ব্রুনুর রচিত ‘উমর ইবনে আব্দিল আযীয’ (পৃ. ১৪২)]
উমর ইবনে আব্দিল আযীযের মৃত্যুর সময় এ মর্মে তাকে তিরস্কার করা হচ্ছিল যে, তিনি সন্তানদেরকে দরিদ্র যাচ্ছেন। তখন তিনি সন্তানদেরকে ডেকে পাঠালেন। তারা ছিল দশজনের বেশি। তাদের দিকে তাকিয়ে তার চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল। তারপর বললেন: ‘হে আমার ছেলেরা, তোমাদের বাবার সামনে দুটি সুযোগ ছিল: হয় তোমরা ধনী হবে, আর তোমাদের বাবা জাহান্নামে ঢুকবে। নতুবা তোমরা দরিদ্র হবে, আর তোমাদের বাবা জান্নাতে ঢুকবে। তোমরা ধনী হবে এবং তোমাদের বাবা জাহান্নামে ঢুকবে এর চেয়ে তোমরা দরিদ্র হবে এবং তোমাদের বাবা জান্নাতে ঢুকবে এটা আমার কাছে বেশি পছন্দনীয় ছিল। তোমরা উঠে যাও। আল্লাহ তোমাদেরকে রক্ষা করুন।’
আল্লাহই তৌফিকদাতা।