নামাযে মাসবুকের বিধানসমূহ

প্রশ্ন: 246225

নামাযে মাসবুকের বিধানসমূহ বিস্তারিত জানতে চাই।  

উত্তর

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, দুরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূলের প্রতি। পর সমাচার:

এক:

‘আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা’ গ্রন্থে (৩/৩৫৩) এসেছে: ‘মাসবুক হচ্ছে এমন ব্যক্তি যার আগে ইমাম নামাযের সকল রাকাত বা কিছু রাকাত পড়ে ফেলেছেন।’[সমাপ্ত]

দুই:

মাসবূকের বিধানসমূহ:

১. মাসবূক ব্যক্তির জন্য মুস্তাহাব হচ্ছে সে ধীর-স্থিরতা ও গাম্ভীর্যের সাথে মসজিদে আসবে।

মাসবূক ইমামের সাথে নামাযের যে অংশ পাবে সেটি তার নামাযের প্রথম অংশ। উদাহরণস্বরূপ মাসবূক যদি ইমামের সাথে মাগরিবের নামাযের দ্বিতীয় রাকাত পায়, তাহলে এটি ইমামের দ্বিতীয় রাকাত, আর মাসবূক নামাযীর প্রথম রাকাত।

এই দুটি হুকুমের দলীল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: যখন তোমরা ইকামত শুনতে পাবে তখন নামাযের দিকে হেঁটে আসবে, তোমাদের উচিত স্থিরতা ও গাম্ভীর্য অবলম্বন করা। তাড়াহুড়া করবে না। ইমামের সাথে যতটুকু পাও তা আদায় করবে, আর যা ছুটে যায় তা পূর্ণ করবে[হাদীসটি বুখারী (৬০০) বর্ণনা করেন]

কিছু আলেম ব্যতিক্রম হিসেবে বলেছেন যে যদি জামাত ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে সে সামান্য গতি বাড়াতে পারে; যাতে জামাত ধরতে পারে।

২. মাসবূক ব্যক্তি যদি ইমামকে রুকু অবস্থায় ধরতে পারে তাহলে তার জন্য দাঁড়ানো অবস্থায় তাকবীরে তাহরীমা বলা আবশ্যক। ঝুঁকে পড়া অবস্থায় তাকবীরে তাহরীমা বললে তার নামায সঠিক হবে না।

ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘যে ক্ষেত্রে দাঁড়ানো আবশ্যক সে ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরীমা বলা আবশ্যক। অনুরূপভাবে যে মাসবূক ব্যক্তি ইমামকে রুকু অবস্থায় পায়, তার জন্য দাঁড়ানো অবস্থায় তাকবীরে তাহরীমার বাক্য পূর্ণরূপে বলতে হবে। যদি দাঁড়ানো অবস্থার বাইরে তাকবীরের একটি হরফও উচ্চারণ করে তাহলে তার ফরয নামায হবে না। এ নিয়ে কোনো মতভেদ নেই।’[সমাপ্ত][আল-মাজমূ (৩/২৯৬)]

৩. মাসবূক ব্যক্তি যদি এমতাবস্থায় পৌঁছান যে ইমাম রুকুতে আছেন তাহলে তার জন্য সতর্কতা হিসেবে দু’টি তাকবীর বলা বাঞ্ছনীয়: প্রথমটি তাকবীরে তাহরীমা ও দ্বিতীয়টি রুকুর তাকবীর। যদি শুধু তাকবীরে তাহরীমা বলে এবং রুকুর তাকবীর বলা ছাড়া রুকু করে তাহলে আলেমদের বিশুদ্ধ মতানুসারে সেটি তার জন্য যথেষ্ট হবে।

শাইখ ইবনে বায রাহিমাহুল্লাহুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: ‘যদি মুক্তাদি নামাযে এমন সময়ে আসে যে ইমাম রুকুতে আছেন, তাহলে সে কি শুরুর তাকবীর ও রুকুর তাকবীর দিবে; নাকি তাকবীর দিয়ে রুকুতে চলে যাবে?

উত্তর: উত্তম ও সতর্কতা হচ্ছে উভয় তাকবীর প্রদান করা: প্রথমটি তাকবীরে তাহরীমা যা একটি রোকন এবং এটি অবশ্যই দাঁড়ানো অবস্থায় দিতে হবে। আর দ্বিতীয়টি রুকুর তাকবীর যা রুকু দেওয়ার সময়ে দিতে হবে। যদি সে কোনো রাকাত ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা করে তাহলে আলেমদের বিশুদ্ধ মতানুসারে শুধু তাকবীরে তাহরীমা তার জন্য যথেষ্ট হবে। কারণ দু’টি ইবাদত একই সময়ে একত্রিত হয়েছে। ফলে বড়টি (তাকবীরে তাহরীমা) ছোটটির (রুকুর তাকবীরের) পক্ষ থেকে যথেষ্ট হয়েছে। অধিকাংশ আলেমের মতে এই রাকাত যথেষ্ট হবে।’[সমাপ্ত][মাজমূউ ফাতাওয়া ইবনে বায (১১/২৪৫)]

৪. যদি মুক্তাদি ইমামকে রুকুরত অবস্থায় পেয়ে থাকে তাহলে তার জন্য ঐ রাকাত যথেষ্ট হবে; যদিও ইমাম মাথা ওঠানোর পরে মুক্তাদি তাসবীহ পড়ে থাকে।

৫. যদি মাসবূক ব্যক্তির মনে সংশয় থাকে যে সে কি ইমামের সাথে রুকু পেয়েছে নাকি পায়নি, এমন অবস্থায় সে তার প্রবল ধারণাকে গ্রহণ করবে। যদি তার প্রবল ধারণা হয় যে সে রুকুরত অবস্থায় ইমামকে পেয়েছে তাহলে সে রাকাত পেয়েছে বলে গণ্য হবে। আর যদি তার প্রবল ধারণা হয় যে সে রুকু পায়নি তাহলে সে রাকাত পায়নি বলে গণ্য হবে।

শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহুর ‘আশ-শারহুল মুমতি’ গ্রন্থে  (৩/৩৮৩) এসেছে:

‘মাসয়ালা: যদি কোনো ব্যক্তি এসে দেখতে পায় ইমাম রুকু অবস্থায় আছে, এরপর সে তাকবীরে তাহরীমা দিয়ে রুকুতে যায়। পরবর্তীতে তার মনে সংশয় হয় যে সে কি ইমামকে রুকুতে পেয়েছে, নাকি ইমামকে ধরার আগে ইমাম রুকু থেকে উঠে গিয়েছে; তাহলে লেখকের মতে এই রাকাত ধর্তব্য হবে না। কারণ সে রুকু পেয়েছে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে আছে। এমন অবস্থায় যে বিষয়ে তার দৃঢ় বিশ্বাস আছে সেটির উপর সে থাকবে। সেটি হচ্ছে যে সে রুকু পায়নি। ফলে তার এই রাকাত গণ্য হবে না।

আর দ্বিতীয় মত হচ্ছে: প্রবল ধারণা অনুযায়ী আমল করা। আমরা বলব: আপনার প্রবল ধারণায় আপনি কি ইমামকে রুকুতে পেয়েছন; নাকি পাননি? যদি তিনি বলেন: হ্যাঁ, আমার প্রবল ধারণা আমি ইমামকে রুকুতে পেয়েছি। তাহলে আমরা বলব: আপনার জন্য রাকাতটি গণ্য হবে। আর যদি তিনি বলেন: আমার প্রবল ধারণা হচ্ছে আমি রাকাত পাইনি। তাহলে আমরা বলব: আপনি এই রাকাত গণনা না করে নামায পূর্ণ করুন। যদি তিনি বলেন: আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছি। আমি রাকাতটি পেয়েছি বলে আমার প্রবল ধারণা হচ্ছে না। তাহলে আমরা বলব: আপনি যেটা সুনিশ্চিত সেটার উপর নির্ভর করুন। এই রাকাতটি গণনা না করে নামায পূর্ণ করুন।’[সমাপ্ত]

৬. মাসবূক ব্যক্তির জন্য কাতারের পেছনে একাকী নামায পড়া জায়েয হবে, যদি সে তার সামনের কাতারে কোনো জায়গা না পায়।

৭. ইমাম যদি এক রাকাত বেশি পড়েন তাহলে মাসবূক কি সেই অতিরিক্ত রাকাত গণনা করবে? বিষয়টি নিয়ে আলেমদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে।

শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: ‘যদি ইমাম (ভুলবশত) পাঁচ রাকাত পড়ে, আর কোনো ব্যক্তি দ্বিতীয় রাকাতে তার সাথে শরীক হয়, তাহলে সে কি ইমামের সাথে সালাম ফেরাবে; নাকি আরো এক রাকাত পড়বে?

তিনি উত্তর দেন: এ বিষয়ে আলেমরা মতভেদ করেছেন। কিছু আলেম মনে করেন, ইমাম যদি পাঁচ রাকাত পড়ে সালাম ফেরায়, তাহলে মাসবূকের জন্য আরও এক রাকাত পড়া আবশ্যক। এ অবস্থায় সে যেন ইমামের মত করেই পাঁচ রাকাত পড়ল। এর সপক্ষে প্রমাণ হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “ইমামের সাথে যতটুকু পাও তা আদায় করবে, আর যা ছুটে যায় তা পূর্ণ করবে।” তাদের মতে উক্ত ব্যক্তির এক রাকাত ছুটে গিয়েছে, সুতরাং তাকে এটি আদায় করতে হবে।

কিন্তু অগ্রগণ্য অভিমত হলো: তার জন্য পঞ্চম কোনো রাকাত আদায় করা জায়েয হবে না। বরং এমন ক্ষেত্রে সে ইমামের সাথেই সালাম ফেরাবে। কারণ ইমাম ভুলবশতঃ পঞ্চম রাকাত পড়েছে, ইমামের ওজর আছে। অন্যদিকে এই ব্যক্তির কোনো ওজর নেই। তিনি যেহেতু জানতে পেরেছেন যে তিনি চার রাকাত নামায পড়েছেন, এরপরে তার জন্য নামাযে বৃদ্ধি করা বৈধ নয়।

আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: ‘যা ছুটে যায় তা পূর্ণ করবে’ এখানে ‘পূর্ণ করবে’ কথাটি প্রমাণ করে যে যা ছুটে গিয়েছে তার ফলে নামাযে ঘাটতি হয়েছে। কিন্তু সে যদি ইমামের সাথে চার রাকাত পড়ে তাহলে তো তার নামাযে কোনো ঘাটতি হয়নি। উক্ত হাদীসের জবাব এটিই। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।[সমাপ্ত][মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে উছাইমীন (১৪/২০)]

দেখুন: (49046) ও (87853) নং প্রশ্নের উত্তর।

৮. ইমাম যদি সালাম ফেরানোর আগে সাহু সিজদা দেয় তাহলে মাসবূক তার সাথে সাহু সিজদা দিবে; মাসবূক সেই সাহু তথা ভুলের সময় নামাযে অংশগ্রহণ করুক কিংবা ভুলের পরে নামাযে অংশগ্রহণ করুক; উভয় অবস্থাতেই (সে সাহু সিজদা দিবে)। যদি সালাম ফেরানোর পরে ইমাম সাহু সিজদা দেয় তাহলে মাসবূক সিজদার ক্ষেত্রে ইমামের অনুসরণ করবে না। কারণ এমন অবস্থায় তাকে অনুসরণ করা তার জন্য সম্ভবপর নয়।

৯. মাসবূক অন্তত এক রাকাত না পাওয়া ছাড়া জামাত পেয়েছে বলে গণ্য হবে না। রুকু পাওয়ার মাধ্যমেই রাকাত পাওয়া যায়।

‘ফাতাওয়াল-লাজনাহ আদ-দাইমাহ’ (৬/২২৫)-তে এসেছে:

‘সঠিক মত অনুসারে মাসবূক ব্যক্তি এক রাকাত পাওয়া ছাড়া জামাত পেয়েছে বলে গণ্য হবে না। কারণ হাদীসে এসেছে: ‘যে ব্যক্তি কোনো নামাযে এক রাকাত পেয়েছে সে নামাযটি পেয়েছে।’[হাদীসটি মুসলিম তার সহিহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন] আর রুকু পাওয়ার মাধ্যমেই রাকাত পাওয়া যায়।[সমাপ্ত]

১১. মাসবূক যদি শেষ রুকুর পরে পৌঁছে তাহলে তার জন্য ইমামের সাথে নামাযে প্রবেশ করাই উত্তম। সে অন্য জামাতের অপেক্ষা করবে না।

‘ফাতাওয়াল-লাজনাহ আদ-দাইমাহ’ (দ্বিতীয় খণ্ড, ৬/২২৫)-তে এসেছে:

‘যদি মুসলিম ব্যক্তি শেষ রাকাতের রুকুর পরে আসে তাহলে তার জন্য ইমামের সাথে যা পায় তাতেই অংশগ্রহণ করা উত্তম। এর কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীর ব্যাপকতা যেখানে তিনি বলেছেন: “যখন তোমরা নামাযে আসবে তখন তোমাদের উচিত স্থিরতা ও গাম্ভীর্য অবলম্বন করা। ইমামের সাথে যতটুকু পাও তা আদায় করবে, আর যা ছুটে যায় তা পূর্ণ করবে।” তাঁর এ বক্তব্য শেষ রুকুর আগের ও পরের উভয় অবস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করে।’[সমাপ্ত]

১২. মাসবূক ব্যক্তির যদি জুমার নামাযের দ্বিতীয় রাকাতের রুকু ছুটে যায় তাহলে সে জুমার নামায পেয়েছে বলে গণ্য হবে না। তাই সে যদি এমন সময়ে এসে পৌঁছায় যখন ইমাম জুমার দ্বিতীয় রাকাতের রুকু থেকে উঠে গিয়েছেন তাহলে তার জুমা ছুটে গিয়েছে বলে গণ্য হবে। এ অবস্থায় সে ইমামের সাথে নামাযে যোগ দিবে এবং ইমাম সালাম ফেরানোর পরে সে নামাযটি যোহর হিসেবে পূর্ণ করবে। আরো জানতে (12601) নং প্রশ্নের উত্তর দেখুন।

১৩. মাসবূক ব্যক্তির জন্য সতর্কতা হচ্ছে: তার নামাযের যে অংশটি ছুটে গিয়েছে সেটি আদায় করার জন্য সে ততক্ষণ পর্যন্ত উঠবে না যতক্ষণ না ইমাম দ্বিতীয় সালাম ফেরানো শেষ করে।

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

সূত্র

সূত্র

ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

answer

সংশ্লিষ্ট প্রশ্নোত্তরসমূহ

at email

নিউজলেটার

ওয়েবসাইটের ইমেইল ভিত্তিক নিউজলেটারে সাবস্ক্রাইব করুন

phone

ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব অ্যাপ্লিকেশন

কন্টেন্টে আরও দ্রুত পৌঁছতে ও ইন্টারনেট ছাড়া ব্রাউজ করতে

download iosdownload android