‘বস্তুর মূল হুকুম বৈধতা’ আলেমরা এই মূলনীতি শরয়ি দলীল থেকে উদ্ভাবন করেছেন। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা রাহিমাহুল্লাহ তাআলা বলেন: ‘জেনে রাখুন, অস্তিত্বশীল বস্তুসমূহের প্রকারের ভিন্নতা ও বৈশিষ্ট্যের বৈচিত্র সত্ত্বেও সেগুলোর মূল হুকুম মানুষের জন্য শর্তহীন হালাল হওয়া এবং সেগুলো পবিত্র হওয়া, তাই সেগুলো ব্যবহার করা, সেগুলোকে ধরা ও স্পর্শ করা হারাম নয়। এটি একটি সামগ্রিক বাণী, ব্যাপক কথা, মর্যাদাপূর্ণ বিষয়, খুবই উপকারী ও বরকতময় বক্তব্য। মানুষের অগণিত আমল ও ঘটনার ক্ষেত্রে শরীয়তের বাহকেরা (আলেমরা) এই মূলনীতির শরণাপন্ন হন। এই মুহূর্তে আমি যা মনে করতে পারছি তা হলো শরীয়তের দশ শ্রেণীর দলীল এ মূলনীতির সপক্ষে প্রমাণ বহন করে। সেগুলো হচ্ছে: আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাহ, মুমিনদের পথের অনুসরণ যার কথা আল্লাহর এ বাণীতে রয়েছে: ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রাসূলের আনুগত্য করো, আর আনুগত্য করো তোমাদের মধ্যকার দায়িত্বশীলদের।’ এবং এ বাণীতে রয়েছে: ‘তোমাদের অভিভাবক হচ্ছেন আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং যারা ঈমান এনেছে।’ আরো রয়েছে: مسلك القياس (কিয়াসের পদ্ধতিসমূহ), الاعتبار (যুক্তি), مناهج الرأي (যুক্তিগত পদ্ধতিসমূহ) এবং الاستبصار (অনুসন্ধান)।’[সমাপ্ত][মাজমুউল ফাতাওয়া (২১/৫৩৫)]
তারপর ইবনে তাইমিয়্যা রাহিমাহুল্লাহ এর সপক্ষে দলীলগুলো উপস্থাপন করেন। যে কিতাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে দলীলগুলো দেখা যেতে পারে।
এই মূলনীতির অর্থ হচ্ছে: পৃথিবীর বুকে যত উপকারী বস্তু রয়েছে এবং সেসব বস্তু থেকে মানুষ যা কিছু বের করে এনেছে; সে সব থেকে উপকৃত হওয়া বৈধ; যতক্ষণ না তা হারাম হওয়ার পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়।
দুই:
খাদ্য, পানীয়, পোশাক, পরিষ্কারক উপাদান প্রভৃতির ক্ষেত্রে এই মূলনীতির উপর আমল করা যাবে, যেগুলোর ব্যাপারে সরাসরি কোন শরয়ি দলিল উদ্ধৃত হয়নি। এই মূলনীতি থেকে ব্যতিক্রম দুটি বিষয়:
প্রথমত:
যে বস্তুগুলোতে বিবেচনাযোগ্য ক্ষতি ও নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। কারণ ক্ষতিকর উপাদানের মূল বিধান হচ্ছে হারাম হওয়া। তাই এটি ‘বস্তুর মূল হুকুম বৈধতা’ এই মূলনীতির অধিভূক্ত হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ
“তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।”[সূরা বাকারা: ১৯৫]
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلَا تَقْتُلُوا أَنفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا
“তোমরা নিজেদেরকে নিজে হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়াবান।”[সূরা নিসা: ২৯]
আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “ক্ষতি করা নয় এবং পাল্টাপাল্টি ক্ষতি করাও নয়।”[ হাকেম হাদীসটি (২/৫৭-৫৮) বর্ণনা করেন এবং বলেন: হাদীসটির সনদ সহীহ, মুসলিমের শর্তে উত্তীর্ণ। শাইখ আলবানী সিলসিলাতুল আহাদীস আস-সহীহাহ গ্রন্থে (১/৪৯৮) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]
শাইখ মুফাস্সির মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শাঙ্কীতী রাহিমাহুল্লাহ উক্ত বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান করে বলেন:
‘যদি বস্তুসমূহের মধ্যে নিরেট ক্ষতি থাকে; কোনো উপকারের মিশ্রণ না থাকে; তাহলে সেটি হারাম। যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘ক্ষতি করা নয় এবং পাল্টাপাল্টি ক্ষতি করাও নয়।’ আর যদি তাতে একদিক থেকে উপকার থাকে, অন্যদিক থেকে ক্ষতি থাকে; তাহলে এর তিনটি অবস্থা:
এক: উপকারের মাত্রা ক্ষতির চেয়ে বেশি।
দুই: এর বিপরীত (ক্ষতির মাত্রা বেশি)।
তিন: উভয়টি সমান।
যদি ক্ষতির মাত্রা উপকারের চেয়ে বেশি হয় কিংবা উভয়টি সমান হয় তাহলে সেটি হারাম। দলিল হলো: ‘ক্ষতি করা নয় এবং পাল্টাপাল্টি ক্ষতি করাও নয়’ শীর্ষক হাদীস। আর যেহেতু 'অনিষ্ট রোধ করা কল্যাণ আনয়নের উপর অগ্রগণ্য'।
আর যদি উপকারের মাত্রা বেশি হয় তাহলে অগ্রগণ্য মত হলো সেটি জায়েয হওয়া। কেননা উসুলুল ফিকহের একটি স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম হলো: অপ্রাধান্য অনিষ্টের উপর প্রাধান্যপ্রাপ্ত কল্যাণ অগ্রগণ্যতা পাবে।’[সমাপ্ত][আদ্বওয়াউল বায়ান (৭/৭৯৩-৭৯৪)]
দ্বিতীয়ত:
গোশত ও যবাইকৃত পশুর ক্ষেত্রে মূল হুকুম হচ্ছে হারাম হওয়া। কারণ গোশত ও যবাইকৃত পশু খাওয়া বৈধ হবে না, যদি না যবাইয়ের শর্তাবলি মেনে যবাই করা সাব্যস্ত হয়।
খাত্তাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “পক্ষান্তরে যে বস্তুর মূল হুকুম হারাম; কেবল কিছু শর্তে ও সুনির্দিষ্ট কিছু রূপে সেটাকে বৈধতা দেয়া হয়; যেমন: যৌনাঙ্গসমূহ; বিবাহ কিংবা দাসীর মালিক হওয়া ছাড়া হালাল হয় না, যেমন: বকরির মাংস; শরয়ি জবাই ছাড়া হালাল হয় না; তাহলে যখনই এই শর্তাবলির অস্তিত্বের ব্যাপারে বা যথাযথ বৈশিষ্ট্য নিয়ে নিশ্চিতভাবে শর্তাবলি অর্জিত হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ দেখা দিবে তখনই এটি মূল নিষেধাজ্ঞা ও হারামের উপর বলবৎ থাকবে।”[সমাপ্ত][মা’আলিমুস সুনান (৩/৫৭)]
তবে বকরির গোশত হালাল প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট হলো এতটুকু জানা যে এর যবাইকারী ব্যক্তি মুসলিম অথবা আহলে-কিতাব (ইহুদি-খ্রিষ্টান)। এছাড়া প্রত্যেকটি যবাইকৃত পশুর যবাইয়ের পদ্ধতি নিশ্চিত হওয়ার শর্ত নেই; যেমনটি ইতিপূর্বে (223005) নং ফতোয়ায় বিস্তারিত বলা হয়েছে।
সুতরাং মুসলিম দেশে বা আহলে-কিতাবদের দেশে থাকা যবাইকৃত পশুসমূহের ক্ষেত্রে বিধান হলো এগুলো হালাল; যদি না আমাদের কাছে প্রমাণিত হয় যে এগুলো ইসলামী শরীয়তের বিরোধী কোনো প্রক্রিয়ায় যবাই করা হয়েছে। যেমন: শ্বাসরুদ্ধ করা, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে হত্যা করা কিংবা আল্লাহর নাম উল্লেখ না করা ... প্রভৃতি।
যে উৎপাদিত পণ্য হারাম হওয়ার পক্ষে কোনো শরয়ি দলীল নেই অথবা যার উপাদানসমূহের মধ্যে হারাম বা ক্ষতিকর কিছু লেখা নেই; আমরা সেটি হালাল হওয়া ও পবিত্র হওয়ার হুকুম প্রদান করব। নিছক সন্দেহ বা অনির্ভরযোগ্য বক্তব্যের বশবর্তী হয়ে আমরা এই মূলনীতি থেকে সরে আসব না।
কোনো খাবারে হারাম উপাদানসমূহ প্রবেশ করলে সেটি কি পুরোপুরি হারাম হয়ে যাবে? এ বিষয়ে ইতিপূর্বে (114129) নং ফতোয়াতে বিস্তারিত বলা হয়েছে।
সারকথা হলো: যদি হারাম উপাদান সরাসরি থেকে যায় তাহলে তা খাওয়া হারাম হবে। আর যদি বিভিন্ন কিছুর মিশ্রণে ও বিক্রিয়ায় অন্য বস্তুতে পরিণত হয় এবং প্রাথমিকভাবে হারাম বস্তুটির স্বরূপ অবশিষ্ট না থাকে; তাহলে আলেমদের প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত অনুসারে তা খাওয়া জায়েয হবে।
তিন:
পোশাক-আশাক ‘বস্তুর মূল হুকুম বৈধতা’ মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত হবে। এক্ষেত্রে মূল হুকুম হচ্ছে বৈধতা; কেবল শরীয়ত যা ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচনা করেছে তা ব্যতিরেকে। যেমন: পুরুষদের জন্য রেশমের পোশাক হারাম, যেমন: যে সমস্ত চামড়া প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমেও পবিত্র হয় না। ইতঃপূর্বে (221753) নং ফতোয়ায় এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।