এক:
দানের নেকী বেশি ও গুণিতক হারে কয়েকটি অবস্থায় বাড়ানো হয়। যেমন:
১. যদি গোপনে দান করা হয়।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “আল্লাহ তাআলা সাত ব্যক্তিকে সেই দিনে তাঁর (আরশের) ছায়া দান করবেন যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না: (তারা হল) ... সেই ব্যক্তি যে দান করে গোপন রাখে; এমনকি তার ডান হাত যা প্রদান করে তার বাম হাত পর্যন্তও তা জানতে পারে না।”[হাদীসটি বুখারী (১৪২৩) বর্ণনা করেন]
২. যদি দরিদ্র ব্যক্তির প্রয়োজন তীব্র আকার ধারণ করে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “আল্লাহ তাআলার কাছে সর্বোত্তম আমল হলো কোনো মুসলিমের মনে আনন্দ প্রবেশ করানো অথবা তার বিপদ দূর করা অথবা তার ঋণ পরিশোধ করা অথবা তার ক্ষুধা দূর করা।”[হাদীসটি ত্বাবারানী তার ‘আল-কাবীর’ (১৩৬৪৬) গ্রন্থে বর্ণনা করেন আর শাইখ আলবানী এটিকে হাসান বলে গণ্য করেন]
দেখুন (75406) নং প্রশ্নের উত্তর।
৩. অর্থ সঞ্চয় হলেই দ্রুত দান করা কিংবা মৃত্যু মুমূর্ষু অবস্থার আসার আগেই দান করা।
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল: ‘হে আল্লাহর রাসূল! কোন দান নেকীর দিক দিয়ে বড়?’ তিনি বললেন: “এমন অবস্থায় দান করা (বৃহত্তম নেকীর কাজ) যখন তুমি সুস্থ, অন্তরে অর্থের লোভ আছে, তুমি দরিদ্রতার ভয় কর এবং ধন-দৌলতের আশা কর। তুমি দান করতে গিয়ে এতটা বিলম্ব করো না যে, যখন তোমার প্রাণ কণ্ঠাগত হবে, তখন বলবে: ‘অমুকের জন্য এত, অমুকের জন্য এত। অথচ তা অমুকের (উত্তরাধিকারীর) হয়েই গেছে।”[হাদীসটি বুখারী (১৪১৯) বর্ণনা করেন]
৪. যদি নিকটাত্মীয়কে দান করা হয়। আর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর প্রতি হলে এর নেকী আরও বৃদ্ধি পায়।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “সর্বোত্তম দান হলো শত্রুভাবাপন্ন নিকটাত্মীয়ের প্রতি দান করা।”[হাদীসটি আহমদ (২৩৫৩০) বর্ণনা করেন আর শাইখ আলবানী সহিহ বলে গণ্য করেন]
দেখুন (21810) নং প্রশ্নের উত্তর।
৫. যদি নিজের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও দান করা এবং নিজের উপর অন্যকে প্রাধান্য দেয়া। তবে শর্ত হলো তার উপর যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব রয়েছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া। অবশ্য তারাও যদি রাজী থাকে তাহলে বৈধ হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
“(যুদ্ধলব্ধ সম্পদ তাদের জন্যও) যারা এই মুহাজিরদের আগে এই নগরীতে (মদীনায়) বসবাস করেছে ও ঈমান এনেছে (অর্থাৎ আনসারদের জন্যও)। তাদের কাছে যারা হিজরত করে এসেছে তারা তাদেরকে ভালোবাসে; তাদেরকে যা দেওয়া হয়েছে তার জন্য তারা অন্তরে কোনো চাহিদা পোষণ করে না এবং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও নিজেদের উপর (তাদেরকে) অগ্রাধিকার দেয়। আর যাদেরকে মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে তারাই সফলকাম।”[সূরা হাশর: ৯]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “ব্যক্তির পাপী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে যাদের জীবিকার ব্যাপারে দায়িত্বশীল তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করে না।”[হাদীসটি আবু দাউদ (১৬৯২) বর্ণনা করেন আর শাইখ আলবানী এটিকে হাসান বলেন। সহিহ মুসলিমে (৯৯৬) অনুরূপ বর্ণিত আছে]
বাগাভী শরহুস সুন্নাহ (৯/৩৪২) গ্রন্থে বলেন: ‘উক্ত হাদীসে তুলে ধরা হয়েছে যে কোনো ব্যক্তির জন্য নেকীর আশায় এমন কিছু দান করা সমীচীন নয় যা তার পরিবারের ভরণ-পোষণের অতিরিক্ত নয়। কেননা তাহলে এটি পাপে পরিণত হবে।’[সমাপ্ত]
৬. যদি মর্যাদাপূর্ণ সময় ও স্থানে দান করা হয়।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সবচেয়ে দানশীল মানুষ। আর রমযান মাসে তিনি সর্বাধিক বদান্য হতেন।’[হাদীসটি বুখারী (৬) বর্ণনা করেন]
৭. যদি সাধারণ মুসলিমদের উপর দানের প্রভাব ব্যাপক হয়। যেমন: আল্লাহর রাস্তায় দান করা।
আবু উমামা (রাঃ) বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “সর্বোত্তম দান হলো: আল্লাহর রাস্তায় তাঁবুর ছায়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া (যার দ্বারা মুজাহিদ উপকৃত হয়)। আর আল্লাহর রাস্তায় কোনো খাদেম দান করা (যার দ্বারা মুজাহিদ সেবা গ্রহণ করে)। কিংবা আল্লাহর রাস্তায় (গর্ভধারণের উপযুক্ত হৃষ্টপুষ্ট) উটনী দান করা, (যার দুধ দ্বারা মুজাহিদ উপকৃত হয়)।”[হাদীসটি তিরমিযী বর্ণনা করেন আর শাইখ আলবানী (১৬২৭) এটিকে হাসান বলে গণ্য করেন]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: সর্বোত্তম দান কী? তিনি উত্তর দেন: “পানি পান করানো।”[হাদীসটি নাসাঈ (৩৬৬৪) বর্ণনা করেন আর শাইখ আলবানী এটিকে হাসান বলেন]
মুনাওয়ীর ‘ফাইযুল কাদীর’ গ্রন্থে (২/৩৭) এসেছে: ত্বীবী বলেন: এটি সর্বোত্তম হওয়ার কারণ হলো দ্বীনী ও দুনিয়াবী নেকীর ক্ষেত্রে এর উপকার সবচেয়ে ব্যাপক।... [সমাপ্ত]
৮. একই ধরনের জোড়া বস্তু দান করা।
“যে কেউ আল্লাহর পথে জোড়া বস্তু ব্যয় করবে তাকে জান্নাতের সব দরজা হতে ডাকা হবে, হে আল্লাহর বান্দা! এটা ভালো।”[হাদীসটি বুখারী (১৮৯৭) বর্ণনা করেন]
৯. যদি দানের সাথে রোযা রাখা, জানাযায় উপস্থিতি হওয়া ও অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া একত্রিত হয়।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই চারটির প্রসঙ্গে বলেন: “কোনো ব্যক্তির মাঝে এই চারটি একত্রিত হলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”[হাদীসটি মুসলিম (১০২৮) বর্ণনা করেন]
১০. মুত্তাকী আলেমের দান।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “দুনিয়া চার প্রকার লোকের জন্য: (১) ঐ বান্দা, যাকে আল্লাহ ধন ও (ইসলামের) জ্ঞান দান করেছেন। অতঃপর সে তাতে আল্লাহকে ভয় করে, এর মাধ্যমে নিজের আত্মীয়তা বজায় রাখে। আর এতে যে আল্লাহর হক রয়েছে তা সে বুঝে (এবং আদায় করে)। অতএব সে (আল্লাহর কাছে) সবচেয়ে উৎকৃষ্ট স্তরে অবস্থান করবে।”[হাদীসটি তিরমিযী (২৩২৫) বর্ণনা করেন আর শাইখ আলবানী এটিকে সহিহ বলে গণ্য করেন]
১১. যদি দানের সম্পদটি এর মালিকের প্রিয় বস্তু হয়ে থাকে।
আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা আল-কুয়াইতিয়্যা (২৬/৩৩৬) বইয়ে আছে:
‘দান করার ক্ষেত্রে মুস্তাহাব হলো দানকৃত সম্পদ হবে দানকারীর সবচেয়ে প্রিয় ও পছন্দনীয় সম্পদ। আল্লাহ তাআলা বলেন:
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ
“যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের পছন্দের জিনিস থেকে ব্যয় করবে ততক্ষণ তোমরা পুণ্যের নাগাল পাবে না। আর তোমরা যা কিছু ব্যয় করো আল্লাহ তা ভালো করে জানেন।”[সূরা আলে-ইমরান: ৯২]
কুরতুবী বলেন: সালাফ রাদিয়াল্লাহু আনহুম কোনো কিছু ভালোবাসলে সেটাকে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করতেন।[সমাপ্ত]
১২. পরিবারের জন্য খরচ করা।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “এক দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) তুমি আল্লাহর পথে ব্যয় করলে, এক দীনার ক্রীতদাস মুক্ত করার কাজে ব্যয় করলে, এক দীনার কোনো মিসকীনকে দান করলে, আর এক দীনার তুমি পরিবার পরিজনের জন্য ব্যয় করলে। এ সবের মধ্যে ঐ দীনারের নেকী বেশি যেটি তুমি পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করবে।”[হাদীসটি মুসলিম (৯৯৫) বর্ণনা করেন]
১৩. শরীয়ত প্রণেতা যে বিষয়টির স্থান ও সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যেমন: কুরবানী করা। এটি কুরবানীর মূল্য দান করার চেয়ে উত্তম।
১৪. যদি দানের নেকী মৃত্যুর পরেও জারি থাকে, যদিও তা কম হয়ে থাকে। কারণ বস্তু যদি চলমান থাকে, তাহলে তা পরিমাণে বিপুল হয়।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “বান্দা মারা যাবার সাথে সাথে তার আমল বন্ধ হয়ে যায়, কেবল তিনটি আমল ছাড়া: (১) সদকায়ে জারিয়া তথা প্রবহমান দান, (২) উপকারী জ্ঞান এবং (৩) সুসন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।”[হাদীসটি মুসলিম (১৬৩১) বর্ণনা করেন]
১৫.
দুই:
ব্যক্তির জন্য উত্তম হলো সে যা দান করতে চায়, তা দ্রুত দান করে ফেলা; যাতে তৎক্ষণাৎ নেকী লাভ করে।
আর দ্রুত দান করলে দুটি বিপদ থেকে সে বেঁচে যাবে:
এক: আমল বন্ধ করে দেওয়া মৃত্যু।
দুই: দান করার প্রত্যয় নষ্ট হয়ে যাওয়া।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَالسَّابِقُونَ السَّابِقُونَ أُولَئِكَ الْمُقَرَّبُونَ
“অগ্রগামীরা অগ্রগামীই থাকবে। তারাই হবে নৈকট্যশীল।”[সূরা ওয়াকিয়াহ: ১০-১১]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “এতে আমি খুশী নই যে, আমার কাছে এই উহুদ পাহাড় সমান স্বর্ণ থাকবে এ অবস্থায় তিন দিন অতিবাহিত হবে (বুখারীর এক বর্ণনায় (৬২৬৮) এসেছে: এক রাত অথবা তিন রাত) অথচ তার মাঝ থেকে একটি দীনারও আমার কাছে অবশিষ্ট থাকবে। অবশ্য তা থাকবে যা আমি ঋণ আদায়ের জন্য বাকি রাখব অথবা আল্লাহর বান্দাদের মাঝে এভাবে এভাবে এভাবে ডানে, বামে ও পিছনে খরচ করব।” অতঃপর (কিছুদূর) হেঁটে তিনি বললেন, “প্রাচুর্যের অধিকারীরাই কিয়ামতের দিন নিঃস্ব হবে। অবশ্য সে নয় যে সম্পদকে (ফোয়ারার মত) এভাবে এভাবে এভাবে ডানে, বামে ও পিছনে ব্যয় করে। কিন্তু এ রকম লোকের সংখ্যা নেহাতই কম।”[হাদীসটি বুখারী (৬৪৪৪) বর্ণনা করেন]
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।