ব্যবসায়িক মধ্যস্বত্বভোগী ও দালালের কিছু মাসয়ালার বিধান

প্রশ্ন: 183100

উভয়পক্ষ থেকে দালালির কমিশন গ্রহণ করার বিধান কী? অথবা একপক্ষকে না জানিয়ে অপর পক্ষ থেকে কমিশন নেওয়ার বিধান কী?

উত্তর

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, দুরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূলের প্রতি। পর সমাচার:

এক:

শর্ত মোতাবেক বা লোকরীতি মোতাবেক ক্রেতা বা বিক্রেতা কিংবা উভয়ের কাছ থেকে দালালির জন্য কমিশন গ্রহণ করা জায়েয। এটি মালেকী মাযহাবের অভিমত। যদি কোনো শর্ত বা লোকরীতি না থাকে তাহলে তাদের মতে বিক্রেতা এটি প্রদান করবে।

ড. আব্দুর রহমান ইবনে সালেহ আল-আত্বরাম হাফিযাহুল্লাহ বলেন: ‘যদি কোনো শর্ত এবং লোকরীতি না থাকে তাহলে অগ্রগণ্য অভিমত হচ্ছে এই যে: ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে যে তাকে দালাল নিযুক্ত করেছে সে তার পারিশ্রমিক দিবে। যদি বিক্রেতা তাকে দালাল নিযুক্ত করে তাহলে বিক্রেতা পারিশ্রমিক দিবে। যদি ক্রেতা তাকে দালাল নিযুক্ত করে তাহলে ক্রেতার উপর পারিশ্রমিক আবশ্যক হবে। আর যদি উভয়ে তাকে দালাল নিযুক্ত করে তাহলে উভয়ের মিলে তার পারিশ্রমিক প্রদান করবে।’[আল-ওয়াসাত্বাহ আত-তিজারিয়্যাহ (পৃ. ৩৮২) থেকে সমাপ্ত, আরো দেখুন: হাশিয়াতুদ দুসূকী (৩/১২৯)]

ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি (১৩/১২৯)-তে এসেছে: ‘দালাল কী পরিমাণ কমিশন নিবে সেটি নিয়ে অনেক মতভেদ দেখা গিয়েছে। কখনো ২.৫% আবার কখনো ৫% নিচ্ছে। শরীয়ত অনুযায়ী সে কতটুকু নিবে? নাকি এটি বিক্রেতা ও দালালের মধ্যকার চুক্তি মোতাবেক হবে?

উত্তর ৮,৯: যদি দালাল, বিক্রেতা ও ক্রেতার মাঝে কোন চুক্তি থাকে যে দালাল ক্রেতা থেকে বা বিক্রেতা থেকে অথবা উভয়ের থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন গ্রহণ করবে তাহলে সেটি জায়েয। দালালের কমিশনের নির্দিষ্ট কোন পার্সেন্টিজ নাই। বরং যে ব্যক্তি কমিশন প্রদান করবে তার সাথে চুক্তি ও সে যা দিতে রাজী সেটাই জায়েয হবে। কিন্তু সেটি লোকাচারের সীমারেখায় হওয়া উচিত; যাতে করে দালাল ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন করার জন্য যে পরিশ্রম ও দালালি করেছে এর বিপরীতে সে লাভবান হয়। আবার এতে করে যেন ক্রেতা বা বিক্রেতার উপর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ধার্য হয়ে তাদের কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।’[সমাপ্ত][বকর আবু যাইদ, সালেহ আল-ফাওযান, আব্দুল আযীয আলুশ শাইখ, আব্দুল আযীয ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে বায]

দুই:

যদি দালাল ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে কোনো একজনের দালালি করে তাহলে তার জন্য অন্য পক্ষের সাথে মূল্য বৃদ্ধি অথবা হ্রাসের লক্ষ্যে যোগসাজশ করা জায়েয নেই। কারণ এটি ধোঁকা ও আমানতের খেয়ানতের অন্তর্ভুক্ত। বিশেষতঃ যদি দালাল নিজেই ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তি সম্পন্ন করে। কেননা সেক্ষেত্রে সে উকিল (এজেন্ট)। আর উকিল আমানতদার। সে যা লাভ করবে সেটি তার মক্কেলের প্রাপ্য।

‘মাত্বালিবু উলিন্নুহা’ গ্রন্থে (৩/১৩২) এসেছে: ‘উকিল যে বিক্রেতা থেকে ক্রয় করেছে সেই বিক্রেতা উকিলকে কোন উপহার দিলে সেটি মূলচুক্তিতে যুক্ত হবে; যেহেতু সেই উপহার উকিলের মক্কেলের প্রাপ্য।’

যদি তার ভূমিকা কেবল ক্রেতা অথবা বিক্রেতা খোঁজ করে দেওয়ার মধ্যে সীমিত থাকে, চুক্তি করা নয় এবং তাকে কোন দর নির্ধারণ করে দেয়া না হয়, বরং তাকে বলা হয় ক্রয় বা বিক্রয়ে সবচেয়ে ভালো দাম সন্ধান করতে; তাহলে তার মক্কেল ছাড়া অন্য কারো সাথে কোন যোগসাজশ করা ধোঁকা ও খেয়ানত বলে গণ্য হবে।

তবে ফকীহদের মাঝে কেউ কেউ সাধারণভাবে দালালিকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এজেন্ট হওয়া হিসেবে গণ্য করেন।[দেখুন: ড. আব্দুর রহমান ইবনে সালেহ আল-আত্বরাম ‘আল-ওয়াসাত্বাহ আত-তিজারিয়্যাহ’ (পৃ. ১১৫)]

তিন:

যদি দালাল নির্দিষ্ট কমিশনের বিনিময়ে কোনো এক পক্ষের হয়ে কাজ করেন তাহলে তার জন্য অপর পক্ষকে সেটা জানানো আবশ্যক নয়; এমনকি যদি ঐ কমিশন পণ্যের মূল্যে সংযুক্ত করা হয় তবুও। তবে যদি এত বেশি পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয় যে, এতে ঠক খাওয়ার মত তাহলে এটি নিষিদ্ধ হবে।

বিক্রেতা যদি বলে: তুমি একশতে এটি বিক্রি করবে, তোমার জন্য এর মধ্যে দশ থাকবে, আর পণ্যের মূল্য বাজারে নব্বই থাকে, তাহলে ক্রেতাকে দালালির কমিশনের বিষয়ে জানানো আবশ্যক হবে না; যদি ক্রেতা মূল্যের ব্যাপারে তুষ্ট থাকে এবং এতে কোনো ধরনের ধোঁকা ও প্রতারণা না করা হয়।

একদল ফকিহ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, দালালের পারিশ্রমিক এমন খরচের অন্তর্ভুক্ত যা মুরাবাহা বিক্রয়ে পণ্যের মূল্যের সাথে যোগ করা হয়। অথচ এই বিক্রয় প্রক্রিয়া মূল্য সম্পর্কে সত্য বলার আমানতের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং দরকষাকষির বিক্রয়সমূহে মূল্যের সাথে দালালের পারিশ্রমিক যোগ করা আরও অগ্রাধিকারযোগ্য, যে শ্রেণীর বিক্রয়ে মূল মূল্য জানানো বাধ্যতামূলক নয়।

কাসানী মুরাবাহা বিক্রয় সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন: "মূল দামের সাথে নিম্নোক্ত খরচ যোগ করতে কোনো বাধা নেই: ধোপা, রঙমিস্ত্রি, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, দর্জি, দালাল ও রাখালের পারিশ্রমিক। তাছাড়া ভাড়া, দাসদের খাবার ও পোশাকের খরচ এবং তাদের আবশ্যকীয় অন্যান্য প্রথাগত খরচ। এছাড়াও পশুদের খাদ্যের খরচ।

প্রচলিত রীতিকে বিবেচনা করে এই সবকিছু ধরেই মুরাবাহা ও তাওলিয়া পদ্ধতিতে বিক্রয় করা যাবে। কারণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রচলিত রীতি হলো যে তারা এসব খরচকে মূল দামের সাথে যোগ করে এবং মূল দামের অংশ হিসেবে গণ্য করে।"["বাদায়িউস সানায়ি" (৫/২২৩) থেকে সমাপ্ত]

শাইখ খালিদ আল-মুশাইকিহ হাফিযাহুল্লাহুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল:

‘প্রাচ্যের কোনো একটি দেশে আমার একটি অফিস আছে। এ অফিসের কাজ হচ্ছে ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে উকিল হিসেবে ভূমিকা পালন করা। ক্রেতা যে কোনো দেশ থেকে আসে। আমি তাকে ক্রয় করা ও পণ্য বোঝাইয়ে সহায়তা করি। এর বিনিময়ে আমার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন রয়েছে। এই কমিশন কি হালাল; নাকি হারাম? আমি যদি ক্রয়বিক্রয়ের চুক্তি লেখা ও এতে ক্রেতার সম্মতির পর কারখানা থেকেও কমিশন গ্রহণ করি কিন্তু এই কমিশন নেওয়ার ব্যাপারে ক্রেতা না জেনে থাকে? আল্লাহ আপনাদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।

তিনি উত্তর দেন:

‘আপনি যে কমিশন গ্রহণ করছেন তা দালালি ও মধ্যস্বতভোগ। এটি মৌলিকভাবে জায়েয। কারণ আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূরণ করো।”[সূরা মায়েদা: ১] তিনি আরো বলেছেন: “আল্লাহ বিক্রয়কে হালাল করেছেন; আর সুদকে হারাম করেছেন।”[সূরা বাকারা: ২৭৫] এছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাই্হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “মুসলিমরা নিজেদের (চুক্তিপত্রের) শর্তগুলো পালন করতে বাধ্য।”[হাদীসটি তিরমিযী (১৩৫২) ও আবু দাউদ (৩৫৯৪) এবং এই দুজন ছাড়া অন্যরা আমর ইবনে আউফ আল-মুযানী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন] তবে যদি কোনো শর্তের ফলে শরীয়ত লঙ্ঘিত হয়, যেমন: এমন শর্ত করা যা দেশের প্রণীত আইনের বিরোধী অথবা ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যকার রীতির বিপরীত প্রভৃতি। বিষয়টি হলো যদি ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যকার প্রচলন অথবা তাদের মধ্যকার চুক্তি অথবা সে দেশের প্রচলনের বিপরীত হয় এবং দালালের জন্য ক্রেতার পক্ষ থেকে কমিশন নেওয়ার পরে কারখানা থেকে কমিশন নেওয়া বৈধ না থাকে বা অনুরূপ কিছু হয়ে থাকে; তাহলে জায়েয হবে না। আর যদি এমন কিছু না থাকে তাহলে মৌলিকভাবে সেটি বৈধ।’[ফাতাওয়াল ইসলাম আল-ইয়াওম থেকে সমাপ্ত]

তবে পূর্বোক্ত হুকুম থেকে এ অবস্থাটিকে বাদ দিতে হবে যদি দালাল নিজের পারিশ্রমিকের মাত্রা বৃদ্ধি করে কিংবা নিজের স্বার্থে ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তিতে হস্তক্ষেপ করে ক্রেতার অথবা চুক্তিকারীর ক্ষতি করে; তাহলে সেটি অবশ্যই বৈধতার অন্তর্ভুক্ত হবে না।

শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ আল-মুখতার আশ-শাঙ্কীত্বী হাফিযাহুল্লাহ বলেন:

‘কেউ যদি একশ রিয়ালের বিনিময়ে একটি জমি বিক্রি করতে চায় তখন যদি অন্য একজন তাকে বলে: আমি একশ বিশ রিয়াল দিয়ে বিক্রি করে দিব এবং ক্রেতাকে বলব যে জমির মালিক একশ বিশ রিয়াল চায়, এভাবে বিক্রয় সংঘটিত হয় এবং সে বিক্রেতাকে একশ রিয়াল দিয়ে নিজে বিশ রিয়াল নেয়, এর সাথে ক্রেতার থেকেও কমিশন নেয়; তাহলে এটা কি সঠিক হবে? আল্লাহ আপনাদেরকে নেকী প্রদান করুন।’

তিনি উত্তর দেন: ‘এই প্রশ্নের ভেতরে একাধিক প্রশ্ন আছে:

প্রথমতঃ যদি জমির প্রকৃত মালিক আপনাকে বলে: একশ রিয়ালে এটি বিক্রি করো, তাহলে আপনি আপনার মুসলিম ভাইদের অধিকারগুলো রক্ষা করবেন। বিশেষতঃ যদি দেখতে পান যে এই জমিগুলো তাদের প্রয়োজন কিংবা যারা আপনার কাছ থেকে কিনবে তাদের অর্থ সংকট রয়েছে। এমন ক্ষেত্রে আপনার উচিত আল্লাহকে ভয় করা। যেহেতু এটি সাধারণ মুসলমানদের প্রতি কল্যাণকামিতার অন্তর্ভুক্ত।

কোনো ব্যক্তির জন্য নিজের ভাইদের অধিকার ও প্রয়োজনের দিকে দৃষ্টিপাত না করে অতিমাত্রায় লোভী হওয়া উচিত নয়। যদি অন্য কেউ তার সাথে এমনটি করত তাহলে সে এর প্রতি সন্তুষ্ট হত না। মুসলিম নিজের জন্য যা ভালোবাসে, তার মুসলিম ভাইদের জন্যেও তা ভালোবাসবে। নিজের জন্য যা অপছন্দ করে, তার মুসলিম ভাইদের জন্যও তা অপছন্দ করবে। সুতরাং অল্প মূল্যে বিক্রি করার সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অতি লাভে বিক্রি করা তার জন্য উচিত নয়। ...’

এক পর্যায়ে তিনি বলেন: ‘উত্তম হচ্ছে: ব্যক্তি তার ভাইদের ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করবে। সে ব্যক্তিগত লাভের জন্য বাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না।’[যাদুল মুস্তাক্বনী গ্রন্থের ব্যাখ্যা থেকে সমাপ্ত]

এছাড়া আরো যে বিষয়টি বৈধতার অন্তর্ভুক্ত হবে না সেটি হচ্ছে: যদি ক্রেতা বন্ধু বা আত্মীয় হয়ে থাকে যে দালালের ব্যাপারে সুধারণা রাখে। সে যদি দালালি ও কমিশন গ্রহণের বিষয়টি না জেনে থাকে তাহলে পণ্যের ব্যাপারে দালালের প্রশংসা করা ও পণ্যটি তার কাছে পেশ করা তাকে ধোঁকা দেওয়ার নামান্তর।

ড. সালাহ সাওয়ীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল:

‘আমি ক্রেতাকে না জানিয়ে কিছু অর্থ কমিশন হিসেবে নিয়েছি। এটি কি হারাম; নাকি হালাল?’

তিনি উত্তর দেন: ‘দরূদ ও সালাম আল্লাহর রাসূল, তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবী এবং তাদের মিত্রদের প্রতি। পর সমাচার:

মৌলিকভাবে দালালির কমিশন বৈধ, যদি যে বাণিজ্য চুক্তির দালালি করা হচ্ছে সেটি শরিয়তসম্মত হয়ে থাকে। কিন্তু আপনি যে প্রশ্ন করেছেন সেটার হুকুম অবস্থাভেদে ভিন্ন ভিন্ন হবে। যদি ক্রেতার সাথে আপনার পূর্ব থেকেই ভালো সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব থাকার কারণে সে আপনার কাছ থেকে আশা করে যে আপনি কোনো বিনিময় ছাড়া স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাজটি করে দিচ্ছেন তাহলে আপনার জন্য এই কমিশন গ্রহণ করা সমীচীন নয় যা ক্রেতা আশা করেন না। আর যদি বিষয়টি এমন না হয়ে থাকে, তাহলে মৌলিক বৈধতা জারি থাকবে। আল্লাহ তা’আলা সর্বোচ্চ ও সর্বজ্ঞ।[সমাপ্ত]

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

সূত্র

সূত্র

ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

at email

নিউজলেটার

ওয়েবসাইটের ইমেইল ভিত্তিক নিউজলেটারে সাবস্ক্রাইব করুন

phone

ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব অ্যাপ্লিকেশন

কন্টেন্টে আরও দ্রুত পৌঁছতে ও ইন্টারনেট ছাড়া ব্রাউজ করতে

download iosdownload android