দ্বীনের উপর অবিচল থাকার উপায়সমূহ

প্রশ্ন: 147626

দ্বীনের উপর অবিচলতা এনে দেয় এমন উপায়গুলো কী কী? বিশেষতঃ আমার চারদিকে অনেক ফিতনা, কুপ্রবৃত্তির হাতছানি ও সংশয় বিদ্যমান। আমি যখন রাস্তায় হাঁটি তখন গানের শব্দ শুনি। যখন ঘরে থাকি তখনও রাস্তা থেকে গানের শব্দ আমার কানে আসে। এছাড়া আরো অনেক অনেক ফিতনা। শাইখ, আমি আপনার কাছে দ্বীনদারির দৃঢ়তা ও হেদায়াতের দোয়া চাই।

উত্তর

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, দুরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূলের প্রতি। পর সমাচার:

ফিতনার যুগে যে সকল মাধ্যম দ্বীনের উপর অবিচল থাকতে সাহায্য করে সেগুলো দুই প্রকার:

এক:

ঈমান ও ইয়াক্বীন বৃদ্ধি করে এমন কিছু মাধ্যম। যেগুলো বান্দাকে আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি উৎসাহিত করে এবং নেক আমলের দিকে ধাবিত করে। এগুলোর মাধ্যমে বান্দা ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করে।

এমন মাধ্যমগুলোর মধ্যে রয়েছে: সরল পথের হেদায়াত চেয়ে দোয়া করা। মুসলিমমাত্রই তাকে প্রত্যেক নামাযে দোয়া করতে হয়: اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ  ‘আমাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করুন’।

ইমাম ত্বাবারানী ‘আল-কাবীর’ (৭১৩৫) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন: শাদ্দাদ ইবনে আউস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন: ‘হে শাদ্দাদ ইবনে আউস! যদি তুমি দেখতে পাও যে, মানুষ স্বর্ণ-রৌপ্য সঞ্চয় করছে তখন তুমি এই বাক্যগুলো সঞ্চয় করো: اللهمَّ إنّي أسْألُكَ الثَّباتَ في الأمْرِ وَالعَزِيْمَةَ على الرُّشْدِ وأسْألُكَ مُوْجِباتِ رَحْمَتِكَ وَعَزائِمَ مَغْفِرَتِكَ  “হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আনুগত্যের উপর অবিচলতা ও সৎপথে দৃঢ় থাকার প্রার্থনা করছি। আপনার কাছে আপনার রহমতকে আবশ্যককারী ও আপনার ক্ষমাকে অনিবার্যকারী আমলসমূহ প্রার্থনা করছি...”[পূর্ণ হাদীস। শাইখ আলবানী ‘সিলসিলাতুল আহাদীস আস-সহীহা (৩২২৮) গ্রন্থে এটিকে সহিহ বলে গণ্য করেছেন]

তন্মধ্যে আরও রয়েছে: আল্লাহর দ্বীনের উপর অবিচলতা এবং এ ব্যাপারে কোনো প্রকার ছাড় না দেওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

“আর এই হচ্ছে আমার সরল পথ। অতএব, তোমরা এ পথই অনুসরণ করো; অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না; তাহলে সেসব পথ তোমাদেরকে তার পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে। তিনি তোমাদেরকে এই আদেশ দিয়েছেন যাতে তোমরা (বিভ্রান্তি থেকে) বেঁচে থাকতে পারো।”[সূরা আন’আম: ১৫৩]

তিনি আরো বলেন:

يُثَبِّتُ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ

“আল্লাহ দৃঢ় কথা (তাওহীদের কালেমা) দ্বারা মুমিনদেরকে পার্থিব জীবন ও পরকালে দৃঢ় রাখেন।”[সূরা ইব্রাহীম: ২৭]

কাতাদাহ বলেন: ‘দুনিয়ার জীবনে তিনি তাদেরকে ভালো কাজ ও নেক আমলের মাধ্যমে সুদৃঢ় রাখেন। আর 'আখিরাতে' মানে কবরে।’[তাফসীরে ইবনে কাসীর (৪/৫০২)]

এর মধ্যে আরো রয়েছে: সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা।

ইরবাদ্ব ইবনে সারিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নত ও হিদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাদের সুন্নত অনুসরণ করবে, দাঁত দিয়ে সেটাকে আঁকড়ে ধরবে। দ্বীনের মধ্যে নব উদ্ভাবিত বিষয়গুলো থেকে আপনারা বেঁচে থাকবেন। কারণ প্রতিটি নব-উদ্ভাবিত বিষয় বিদআত। আর প্রতিটি বিদআতই ভ্রষ্টতা।”[হাদীসটি আবু দাউদ (৪৬০৭) বর্ণনা করেন। শাইখ আলবানী সহিহ আবু দাউদে হাদীসটিকে বিশুদ্ধ বলে গণ্য করেন]

এর মধ্যে আরো রয়েছে: বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করা।

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: ‘শয়তান আদম সন্তানের অন্তরের উপর উপুড় হয়ে বসে থাকে। সে যখন (আল্লাহকে) ভুলে থাকে বা গাফেল থাকে তখন তাকে কুমন্ত্রণা দেয়। আর যখন আল্লাহকে স্মরণ করে তখন সে দূরে সরে যায়।’[তাফসীরুত ত্বাবারী (২৪/৭০৯-৭১০)]

দুই:

কিছু মাধ্যম যা ফিতনায় পড়া থেকে রক্ষা করে।

এর মধ্যে রয়েছে: আল্লাহর নির্দেশের উপর ধৈর্যধারণ করা।

আবু দাউদ (৪৩৪১) বর্ণনা করেন: আবু সা’লাবা আল-খুশানী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘তোমাদের সামনে আসছে ধৈর্যের দিনসমূহ। সে সময় ধৈর্য ধারণ করা জ্বলন্ত অঙ্গার হাতে ধারণ করার মতো। ঐ সময়ে আমলকারীর জন্য রয়েছে অনুরূপ পঞ্চাশ জন আমলকারীর নেকী। জিজ্ঞেস করা হল: হে আল্লাহর রাসূল! তাদের মধ্যকার পঞ্চাশ জনের আমল? তিনি বলেন: ‘তোমাদের মধ্যকার পঞ্চাশ জনের আমল।’[শাইখ আলবানী সহীহ আবু দাউদে এই হাদীসটিকে সহিহ বলে গণ্য করেন]

এর মধ্যে আরো রয়েছে: প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য ফিতনা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা। সহীহ মুসলিমে (২৮৬৭) আছে: যায়েদ ইবনে সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস, তিনি বলেন: একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবীদেরকে বলেন: ‘তোমরা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য ফিতনা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও।’ তখন তারা বলল: نَعُوْذُ باللهِ مِنَ الفِتَنِ ما ظَهَرَ مِنْها وما بَطَنَ  ‘আমরা আল্লাহর কাছে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য ফিতনা থেকে আশ্রয় চাই।’

এর মধ্যে আরো রয়েছে: আল্লাহর নজরদারির অনুভূতি ও আল্লাহর অধিকারগুলো সংরক্ষণ।

তিরমিযী (২৫১৬) বর্ণনা করেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “তুমি আল্লাহর (বিধান) রক্ষা কর, আল্লাহ তোমাকে রক্ষা করবেন। তুমি আল্লাহর (অধিকারসমূহ) সংরক্ষণ করবে, তাহলে আল্লাহকে তুমি তোমার সম্মুখে পাবে।”[শাইখ আলবানী সহীহুত তিরমিযীতে হাদীসটিকে সহীহ বলে গণ্য করেন]

শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন:

‘তুমি আল্লাহকে সংরক্ষণ করো, আল্লাহ তোমাকে সংরক্ষণ করবেন— বাক্যটি প্রমাণ করে যে মানুষ যতক্ষণ আল্লাহর দ্বীন সংরক্ষণ করবে ততক্ষণ আল্লাহ তাকে সংরক্ষণ করেন। কিন্তু কীসের ক্ষেত্রে সংরক্ষণ করবেন?

শরীরের সংরক্ষণ, অর্থের সংরক্ষণ, পরিবারের সংরক্ষণ এবং দ্বীনদারির সংরক্ষণ। আর এই শেষোক্তটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ তিনি তোমাকে বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করবেন। কারণ মানুষ যত বেশি হেদায়াতের পথে আগায়, আল্লাহ তার হেদায়াতকে ততবেশি বাড়িয়ে দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: “আর যারা সঠিক পথ অনুসরণ করে, আল্লাহ তাদেরকে বেশি বেশি হেদায়াত এবং তাকওয়া দান করেন।” আর যত বিভ্রান্ত হয়, আল্লাহ তার বিভ্রান্তি আরও বাড়িয়ে দেন। আল্লাহর কাছে পানাহ চাই।’[শারহু রিয়াদিস সালিহীন (পৃ. ৭০)]

এর মধ্যে আরো রয়েছে: নেককার মুমিনদের সাহচর্য গ্রহণ করা এবং তারা ছাড়া অন্য ফিতনাগ্রস্ত ব্যক্তিদের সাহচর্য পরিত্যাগ করা।

আবু দাউদ (৪৯১৮) বর্ণনা করেন: আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘মুমিন মুমিনের দর্পণ। মুমিন মুমিনের ভাই। সে তাকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং অনুপস্থিতিতে তার হেফাযত করে।’[শাইখ আলবানী সহীহ আবু দাউদে এটিকে হাসান বলে গণ্য করেন]

‘তার অনুপস্থিতিতে তার হেফাযত করে’ অর্থাৎ তাকে রক্ষা করে এবং সাধ্যমত তার পক্ষে লড়াই করে।

এছাড়া আবু দাউদে (৪৮৩৩) আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘ব্যক্তি তার বন্ধুর ধার্মিকতার অনুসারী হয়। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকেই যেন লক্ষ্য করে, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে।’[শাইখ আলবানী সহীহ আবু দাউদে হাদীসটিকে হাসান বলেছেন]

দ্বীনের ক্ষেত্রে অবিচলতার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো নিজেকে ফিতনার সম্মুখীন না করা এবং ফিতনা ও এর কারণসমূহ থেকে সর্বাত্মক দূরে থাকার প্রচেষ্টা করা। ফলে অন্তরের অবস্থা পরিশুদ্ধ থাকে এবং সে ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করে। দাজ্জাল সংক্রান্ত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে: “কেউ যদি দাজ্জালের আবির্ভাব শুনতে পায় তাহলে সে যেন তার থেকে দূরে চলে যায়। আল্লাহর কসম! কোনো কোনো ব্যক্তি নিজেকে অবশ্যই (ভালো) মুমিন মনে করে তার কাছে আসবে, কিন্তু দাজ্জাল যে সংশয়গুলো উত্থাপন করবে সেগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সে তাকে অনুসরণ করবে।”[আবু দাউদ (৪৩১৯) বর্ণনা করেন এবং শাইখ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ আবু দাউদে সহীহ বলে গণ্য করেন]

আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের ও আমাদের মুসলিম ভাইদের জন্য দ্বীনের উপর অবিচলতা এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য ফিতনা থেকে নিরাপত্তা কামনা করছি।

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

সূত্র

সূত্র

ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

at email

নিউজলেটার

ওয়েবসাইটের ইমেইল ভিত্তিক নিউজলেটারে সাবস্ক্রাইব করুন

phone

ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব অ্যাপ্লিকেশন

কন্টেন্টে আরও দ্রুত পৌঁছতে ও ইন্টারনেট ছাড়া ব্রাউজ করতে

download iosdownload android