শনিবার 11 শাওয়াল 1445 - 20 এপ্রিল 2024
বাংলা

যে নারীর মাথায় সাজগোজের ফিতা ও কাপড় রয়েছে সে ওযু করার সময় কিভাবে মাথা মাসেহ করবে?

প্রশ্ন

চুলের উপরে সাজ হিসেবে যা কিছু পরা হয়; যেমন- কাপড়, প্লাস্টিকের জিনিস, লোহার জিনিস এবং যেটা দিয়ে চুল বাঁধা হয় সেটা বেশি হোক বা কম হোক— এগুলোর ওপর মাসেহ করা কি জায়েয? প্রত্যেক অংশের চুল আলাদাভাবে বাঁধা কি জায়েয (চুলের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত জড়ো করে একটি লোহার জিনিস দিয়ে সেটাকে বাঁধা) কিংবা অনেকগুলো বেনী করা; এরপর সেগুলোর ওপর মাসেহ করা?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক:

ওযুর ফরয হচ্ছে মাথা মাসেহ করা। আল্লাহ্‌র বাণীর দলিলের কারণে: হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতের জন্য দাঁড়াতে চাও তখন তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাতগুলো কনুই পর্যন্ত ধুয়ে নাও, তোমাদের মাথা মাসেহ কর এবং পায়ের টাখনু পর্যন্ত ধৌত কর।[সূরা মায়িদা, আয়াত: ৬]

আলেমগণ মাসেহ করার অংশ কতটুকু এ নিয়ে মতভেদ করেছেন। গোটা মাথা মাসেহ করতে হবে; নাকি অংশ বিশেষ মাসেহ করলে চলবে? ইমাম মালেক ও আহমাদের অভিমত হচ্ছে গোটা মাথা মাসেহ করতে হবে। এটাই অগ্রগণ্য অভিমত।

ওযুতে মাথা মাসেহ করার দুটো পদ্ধতি উদ্ধৃত হয়েছে:

১। হাত ভিজানোর পর সেই হাত মাথার অগ্রভাগে রাখা; অতঃপর মাথার পেছনে পর্যন্ত মাসেহ করা। এরপর হাতদ্বয়কে মাথার অগ্রভাগ পর্যন্ত পুনরায় ফিরিয়ে নেয়া।

২। গোটা মাথা মাসেহ করা; তবে চুল যেই দিকে ভাঁজ হয়ে আছে সেই দিক বিবেচনা করে। যাতে করে চুলের পজিশন পরিবর্তন না হয়।

যার চুল লম্বা (পুরুষ বা নারী) তার জন্য এই পদ্ধতিটি উপযুক্ত; যাতে করে হাতদ্বয় ফিরিয়ে নিতে গিয়ে তার চুল এলোমেলো হয়ে না যায়।

রুবাঈ বিনতে মুআওয়িয বিন আফরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বাসায় ওযু করলেন; তখন তিনি মাথার চূড়া থেকে গোটা মাথা মাসেহ করলেন। মাথার প্রত্যেক দিক চুলের অভিমুখের দিকে মাসেহ করলেন। চুলের পজিশন নাড়ালেন না।[মুসনাদে আহমাদ (২৬৪৮৪) ও সুনানে আবি দাউদ (১২৮), আলবানী ‘সহিহু আবি দাউদ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

হাদিসের ভাষ্য: مِنْ قَرْن الشَّعْر (চুলের চূড়া) দ্বারা উদ্দেশ্য চূলের উপরের ভাগ। অর্থাৎ মাসেহ শুরু করবে চুলের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত।

আল-ইরাক্বী বলেন: অর্থ হচ্ছে — তিনি মাথার উপর থেকে মাসেহ শুরু করে নীচ পর্যন্ত পৌঁছতেন। এভাবে প্রত্যেক পার্শ্বে আলাদাভাবে করতেন।[আওনুল মাবুদ থেকে সংকলিত ও সমাপ্ত]

ইবনে কুদামা ‘আল-মুগানী’ গ্রন্থে (১/৮৭) বলেন: যদি হাত পুনরায় ফিরালে চুল এলোমেলো হয়ে যাওয়ার আশংকা করে তাহলে হাত ফিরাবে না। এটি ইমাম আহমাদের স্পষ্ট ভাষ্য। কারণ তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: যার চুল কাঁধ পর্যন্ত; সে কিভাবে মাসেহ করবে? তখন ইমাম আহমাদ তাঁর হাতদ্বয় মাথার সামনে থেকে পেছনে একবার সঞ্চালন করলেন এবং বললেন: এভাবে করবে; যাতে করে তার চুল বিক্ষিপ্ত হয়ে না পড়ে। অর্থাৎ সে ব্যক্তি মাথার পেছন পর্যন্ত একবার মাসেহ করবে; পুনরায় হাত ফিরিয়ে নেবে না। আহমাদ বলেন: আলী (রাঃ) এর হাদিসে এভাবে এসেছে। আর চাইলে মাসেহ করতেও পারেন; যেমনটি রুবাঈ’ এর হাদিসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বাসায় ওযু করেছেন। তিনি তার গোটা মাথা মাসেহ করেছেন। চুলের চূড়া থেকে প্রত্যেক পার্শ্ব; চুলের অভিমুখের দিকে। চুলের পজিশন পরিবর্তন করেননি।[সুনানে আবু দাউদ] আহমাদকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: নারী কিভাবে মাসেহ করবেন? তিনি বললেন: এভাবে— তিনি তাঁর হাত মাথার মধ্যখানে রাখলেন। এরপর হাতকে সামনের দিকে টেনে আনলেন। এরপর হাত উঠিয়ে পুনরায় আগের জায়গায় রাখলেন। এরপর মাথার পেছনের দিকে হাতকে টেনে নিলেন। ওয়াজিব অংশটুকুর মাসেহ সম্পূর্ণ করার পর যেভাবেই মাসেহ করুক সেটা জায়েয হবে।[সমাপ্ত]

দুই:

যদি নারীর মাথায় কোন সাজগোজের জিনিস থাকে; যেমন ফিতা, প্লাস্টিক টুকরা ইত্যাদি তাহলে সেগুলো খুলে ফেলা জরুরী; যদি এসব জিনিস মাথার একটি অংশ জুড়ে থাকে। ‘গোটা মাথা মাসেহ করা ওয়াজিব’ এই অভিমতের উপর এই কথা নির্ভরশীল।

আল-বাজী (রহঃ) বলেন:

“যদি কোন নারী কোন পশম বা কৃত্রিম চুল যোগ করে চুল বাড়ানোর চেষ্টা করে সেক্ষেত্রে ওগুলোর ওপর মাসেহ করা জায়েয হবে না। কেননা ওগুলোর কারণে পানি তার সকল চুলে পৌঁছবে না। বরং কিছু চুলে পৌঁছবে। এই অভিমত সব চুল মাসেহ করা ওয়াজিব এর উপর নির্ভরশীল।”[আল-মুনতাক্বা (১/৩৮) থেকে সমাপ্ত]

ইমাম আহমাদ (রহঃ) নারীর মাথা মাসেহ করার ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিল অভিমত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: মাথার অগ্রভাগ মাসেহ করবে।

ইবনে কুদামা (রহঃ) বলেন: “মাথা মাসেহ করার ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই। আল্লাহ্‌ তাআলা তার বাণী: “তোমাদের মাথা মাসেহ কর এর মধ্যে দ্ব্যর্থহীনভাবে তা উল্লেখ করেছেন। তবে কতটুকু অংশ মাসেহ করা ওয়াজিব এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। ইমাম আহমাদ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি সব মানুষের ক্ষেত্রে গোটা মাথা মাসেহ করার কথা বলেছেন। এটি খিরাক্বীর ভাষ্যের বাহ্যিক মর্ম এবং ইমাম মালেকের মাযহাব।

আবার ইমাম আহমাদ থেকে মাথার কিছু অংশ মাসেহ করলে চলবে এমন অভিমতও বর্ণিত রয়েছে। কিছু অংশ মাসেহ করার অভিমত আরও ব্যক্ত করেছেন হাসান, ছাওরী, আওযায়ী, শাফেয়ী ও কিয়াসপন্থীরা। তবে ইমাম আহমাদ থেকে বর্ণিত অগ্রগণ্য অভিমত হচ্ছে: পুরুষের ক্ষেত্রে গোটা মাথা। আর নারীর ক্ষেত্রে মাথার অগ্রভাগ মাসেহ করাই যথেষ্ট।

খাল্লাল বলেন: আহমাদের মাযহাবের আমল হচ্ছে নারী তার মাথার অগ্রভাগ মাসেহ করাই যথেষ্ট। মুহান্না বলেন, আহমাদ বলেছেন: আমি আশা করি নারীর মাথা মাসেহের বিষয়টি সহজতর। আমি তাঁকে বললাম: কেন? তিনি বললেন: আয়েশা (রাঃ) মাথার অগ্রভাগ মাসেহ করতেন।”[আল-মুগনী (১/৮৬) থেকে সমাপ্ত]

এই অভিমতের ভিত্তিতে যদি এ সকল জিনিস তার মাথায় থেকে যায় তাহলে কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু যদি সংখ্যায় বেশি হয় তাহলে খুলে ফেলা উত্তম।

তিন:

নারীর জন্য মাথার চুল বাঁধা কিংবা বেনী করতে কোন অসুবিধা নেই এবং ওযুর ক্ষেত্রে এগুলোর উপরেই তিনি মাসেহ করবেন।

শাইখ উছাইমীন (রহঃ) কে ‘নারীর বাঁধা চুলের উপর মাসেহ করার হুকুম সম্পর্কে’ জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেন: “নারীর জন্য তার মাথার উপর মাসেহ করা জায়েয; তার চুল বাঁধা থাকুক কিংবা ছাড়া থাকুক। তবে নারী তার মাথার চুল মাথার উপরের অংশে উটের কুঁজের মত করে বাঁধবে না। কেননা এতে করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই উক্তির অধীনে পড়ে যাওয়ার আশংকা করছি: এমন নারী যারা পোশাক পরা সত্ত্বেও উলঙ্গ। তাদের মাথা উটের বাঁকা কুঁজের মত। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।[ফাতাওয়াস শাইখ বিন উছাইমীন (১১/১৫২) থেকে সমাপ্ত]

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব