ওজরের কারণে কিংবা ওজর ছাড়া কর্মজীবীর জন্য কর্মক্ষেত্র ত্যাগের হুকুম

প্রশ্ন: 126121

আমি রাষ্ট্রীয় একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে আছি। কখনো কখনো আমার নিজস্ব কাজ করার জন্য অফিস থেকে বেরিয়ে যাই। আমার উপর সরাসরি কোনো দায়িত্বশীল নেই যার কাছে আমি বের হওয়ার অনুমতি নিব। আমি অফিসকালীন সময়ে বের হই; তবে প্রতিষ্ঠানের কাজে কোনো নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে। আমার সাথে মোবাইল ফোন রাখি, যাতে করে কর্মক্ষেত্রে আমাকে কোনো প্রয়োজন হলে ফোন দেওয়া সম্ভব হয়। অধিকাংশ দিন আমি অফিস টাইম শেষ হওয়ার পরেও কিছু সময় অফিসে থাকি। যে সময়টুকু আমি আমার অফিসের বাইরে কাটিয়েছি সেটির ব্যাপারে শরয়ি বিধান কী? আমাকে ফতোয়া দিন, আল্লাহ আপনাদেরকে বরকতময় করুন।

উত্তর

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, দুরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূলের প্রতি। পর সমাচার:

কোন চাকুরীজীবী যে সময়কাল কর্মস্থলে থাকার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ সে সময় জুড়ে কর্মস্থলে থাকতে তিনি বাধ্য; তার কোনো কাজ থাকুক বা না থাকুক। কারণ চাকুরিজীবী বা শ্রমজীবীর চুক্তিতে এটি অন্তর্ভুক্ত থাকে। চাকুরীজীবী হচ্ছে বিশেষ শ্রমজীবী। বিশেষ শ্রমজীবী হলেন এমন ব্যক্তি যার সেবাদান সময়ের মাধ্যমে পরিমাপ করা হয়। সুতরাং তাকে এই সময়টুকু চাকুরীর জন্য নিজেকে ব্যস্ততামুক্ত রাখতে হবে। যদি বিষয়টি চাকুরীজীবীর নির্ধারণের উপর ছেড়ে দেওয়া হয় এবং বলা হয় যে, যখন কাজ থাকে সে কেবল তখন উপস্থিত থাকবে, তাহলে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর না হওয়ায় সকল প্রতিষ্ঠান অকার্যকর হয়ে পড়বে।

চাকুরির ক্ষেত্রে এটাই মূল অবস্থা। অর্থাৎ এটি এমন বিশেষ ভাড়ার অন্তর্ভুক্ত যার মূল্য সময়ের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়।

তবে এর থেকে ব্যতিক্রম হবে: যদি কোনো চাকুরিজীবীকে কোনো কাজে বা ব্যক্তিগত স্বার্থে তার কর্মস্থল থেকে বের হওয়ার প্রয়োজন হয়, যে কাজটি অফিস টাইমের পরে নিয়ে যাওয়া তার জন্য কঠিন হয়, তাহলে সে প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে বের হবে।

আর যদি অবস্থা এমন হয় যেমনটি আপনি উল্লেখ করেছেন যে আপনিই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল এবং অনুমতি গ্রহণের মতো কেউ নেই, তাহলে আমরা বলব: আপনার জন্য এমন বিশেষ প্রয়োজনে বের হওয়া বৈধ যা অফিস টাইমের পরে নিয়ে যাওয়া কঠিন। আপনি নিজেকে অন্যান্য স্টাফদের মতোই মনে করবেন। তাদেরকে যতটা অনুমতি দেন তার চেয়ে নিজেকে বেশি সুযোগ দিবেন না। বরং আপনাকে অন্যদের জন্য আদর্শ হতে হবে। তাদের জন্য আপনি যতটুকু কঠিন করেন না নিজের জন্য ততটুকু কঠিন করবেন। বাস্তবে দেখা যায়, স্টাফরা যদি তাদের ম্যানেজারকে বের হতে দেখে তাহলে তারাও বের হওয়ার ক্ষেত্রে শিথিলতা অবলম্বন করে। কাজ করার ক্ষেত্রেও তারা ঢিলেমি করে। এতে করে ব্যাপক ক্ষতি হয়।

কেবল মোবাইল ফোন সাথে থাকা আর অফিস টাইমের পরে অতিরিক্ত সময় অফিসে থাকা যথেষ্ট নয়। কারণ কর্মস্থলের হক যথাসময়ে আদায় করতে হবে; অফিস টাইমের বাইরে নয়। এটি মানুষের উপর অর্পিত অন্যতম আমানত, চাই অফিসের পরিচালক থাকুক কিংবা না থাকুক। আল্লাহ তাআলা বলেন:

 إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا

“নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যেন তোমরা আমানতসমূহ এর প্রাপকদেরকে প্রদান কর।”[সূরা নিসা: ৫৮]

ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ তার তাফসীরে (১/৬৭৩) বলেন: “আল্লাহ তাআলা জানাচ্ছেন যে তিনি প্রাপকদেরকে কাছে তাদের আমানত প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। হাসান থেকে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে: সামুরা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে তোমাকে আমানত প্রদান করেছে, তাকে আমানত ফিরিয়ে দাও। যে তোমার সাথে খেয়ানত করেছে তার সাথে খেয়ানত করো না।” হাদীসটি আহমাদ ও সুনান প্রণেতারা বর্ণনা করেছেন। হাদিসটি মানুষের উপর আবশ্যকীয় সকল আমানতকে অন্তর্ভুক্ত করে। যেমন: বান্দাদের উপর আল্লাহর হক; যথা: নামায, যাকাত, কাফ্‌ফারা, মানত, রোযা প্রভৃতি যে সমস্ত বিষয়ের আমানত তাকে প্রদান করা হয়েছে এবং যা বান্দারা দেখতে পায় না। আরো রয়েছে: বান্দাদের পারস্পরিক হক, যেমন: সম্পদ গচ্ছিত রাখা প্রভৃতি যে বস্তুগুলো বান্দারা কোনো প্রমাণ ছাড়া একে অন্যের কাছে আমানত হিসেবে রাখে। আল্লাহ সেই আমানতগুলো এর প্রাপকদেরকে প্রদান করার নির্দেশ দিয়েছেন। দুনিয়ায় যদি কেউ এটি না করে, তাহলে কিয়ামতের দিন তার কাছ থেকে এটি আদায় করা হবে।”[সমাপ্ত]

পরিচালক ও দায়িত্বশীলদের কর্মস্থল ত্যাগে শিথিলতার কারণেই সেগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর বিপরীতে আপনি দেখবেন যে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল ব্যক্তি আগেভাগে হাজির হয় এবং কাদাচিৎ অফিস থেকে বের হয়, সে প্রতিষ্ঠানের স্টাফরাও নিয়ম মেনে চলে এবং তাদের কাজগুলো সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়।

দায়িত্বশীল ব্যক্তির জানা উচিত যে তাকে প্রদত্ত দায়িত্বসমূহের মাঝে অন্যতম হলো: কর্মকর্তাদের কাজ তত্ত্বাবধান করা, মূল্যায়ন করা, দিক-নির্দেশনা প্রদান করা এবং তাদের উপর তার নজরদারি ও জবাবদিহিতার বিষয়টি তাদেরকে জানিয়ে দেয়া।

এ বিষয়টির গুরুত্ব ও এ সম্পর্কে বিপুল সংখ্যক প্রশ্ন থাকার কারণে আমরা এ সম্পর্কে আলেমদের কিছু ফতোয়া উল্লেখ করছি:

১- ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: চাকুরীজীবীরা অফিস টাইমে অফিস করতে আদিষ্ট, কিন্তু তারা অফিস চলাকালে অনুমতি ছাড়া ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য বেরিয়ে যায়। তাদের এই কাজের হুকুম কী?

কমিটি উত্তর দেয়: চাকুরিজীবীর জন্য অফিসকালীন সময়ে ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য বের হওয়া জায়েয নেই; ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাকে এ বিষয়ে অনুমতি দিক বা না দিক। কারণ এর মধ্যে শাসকের নির্দেশ অমান্য করা হয়। কেননা এই কাজটি নিষিদ্ধ। উপরন্তু, এতে করে তার উপরে ন্যস্ত কাজটি নষ্ট হয়, যার ফলশ্রুতিতে তার কাজের সাথে সম্পৃক্ত মুসলিমদের অধিকার বিনষ্ট হয় এবং তা পূর্ণরূপে আদায় হয় না। আবু ইয়া’লা ও আসকারী বর্ণনা করেন, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মারফূ’ সূত্রে বর্ণনা করেন: তিনি বলেন: "নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন তোমাদের কেউ কোনো কাজ করলে সে যেন তার নিখুঁতভাবে করে।” বাইহাকী ও ত্বাবারানী অনুরূপ বর্ণনা করেন।[সমাপ্ত][ফাতাওয়াল-লাজনাহ আদ-দাইমাহ: (২৩/৪১৫)]

২- শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: আইন হলো রাষ্ট্রীয় সরকারী অফিস টাইম মানা। কেউ কেউ আধা ঘণ্টা দেরী করে আসে কিংবা সময় শেষ হওয়ার আধা ঘণ্টা আগে সে চলে যায়। আবার কখনো এক ঘণ্টা বা তার চেয়ে বেশি সময় বিলম্ব করে। এমন কাজের হুকুম কী?

তিনি বলেন: ‘আমার মনে হয় এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ বিনিময়কৃতের বিপরীতে বিনিময় হওয়া আবশ্যক। তাই সরকারী চাকুরিজীবী এতে সন্তুষ্ট হবেন না যে, রাষ্ট্র তার বেতন থেকে কোনো কিছু কেটে রাখুক, তদ্রূপ তার জন্যেও রাষ্ট্রের কোনো অধিকার কমানো উচিত নয়। তাই অফিসের নির্ধারিত সময় থেকে বিলম্বে যাওয়া কোনো মানুষের জন্য জায়েয নেই। এবং অফিস টাইম শেষ হওয়ার আগেও চলে যাওয়া জায়েয নয়।’

প্রশ্নকর্তা: ‘কিন্তু কেউ কেউ দাবি করে যে মূলত কোনো কাজই নেই। কারণ তার কাজ কম?’ শাইখ বলেন: বিষয়টা হলো আপনি সময়ের ক্ষেত্রে তাদের সাথে দায়বদ্ধ; কর্মের ক্ষেত্রে নয়। অর্থাৎ আপনাকে বলা হয়েছে: আপনাকে বেতন প্রদান করা হলো এই শর্তে যে, আপনি এই সময় থেকে এই সময় পর্যন্ত থাকবেন; আপনার কাজ থাকুক বা না থাকুক। যেহেতু আপনার বেতন সময়ের সাথে সম্পৃক্ত, সেহেতু পুরো সময়টা আপনাকে দিতে হবে। অন্যথায় আমরা যে সময়টি ছিলাম না সেটির বেতন খাওয়া বাতিল বলে গণ্য হবে।’[লিকাউল বাবিল মাফতূহ: (৯/১৪)]

৩- তাকে আরো জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: কিছু চাকুরিজীবী অফিস টাইম শেষ হওয়ার আগে চলে যায় কিংবা অফিস চলাকালীন সময়ে অফিস বাদ দিয়ে বেরিয়ে যায়, আবার ফিরে আসে কিংবা অফিসে দেরীতে আসে; এর হুকুম কী?

তিনি বলেন: ‘কোনো সরকারী চাকুরিজীবীর জন্য অফিস টাইম শেষ হওয়ার আগে বের হওয়া বৈধ নয়। অফিস টাইমের শুরুতে দেরী করাও বৈধ নয়। অফিস টাইম চলাকালীন বেরিয়ে যাওয়াও বৈধ নয়। কারণ তার এই অফিস টাইমের মালিক রাষ্ট্র, অফিস টাইমের বিনিময়ে রাষ্ট্র তাকে কোষাগার থেকে অর্থ দেয়। তবে যেটা প্রচলিত আছে, অফিস টাইম চলাকালীন কারো বের হওয়ার প্রয়োজন পড়লে যদি সে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অথবা পরিচালক থেকে অনুমতি নেয় এবং সে বেরিয়ে গেলেও কাজ বাধাগ্রস্ত না হয়, তাহলে আশা করি এতে কোনো সমস্যা হবে না।’[সমাপ্ত]

৪- শাইখ সালিহ আল-ফাউযান হাফিযাহুল্লাহুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: কিছু সরকারী কর্মকর্তা আছে যাদের কাছে সেবাপ্রার্থী কম। তারা অফিস টাইম শেষ হওয়ার আগেই দুপুরে বেরিয়ে যায়। তারপর তাদেব স্ত্রীদের সাথে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার ফিরে এসে অফিস টাইম শেষ হওয়া পর্যন্ত অফিস করে। .. এই কাজটি কি বৈধ? তাদের জন্য আপনাদের উপদেশ কী?

তিনি উত্তর দেন: ‘চাকুরিজীবীকে অবশ্যই অফিস টাইমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কর্মস্থলে থাকতে হবে। তার জন্য অফিস টাইম চলাকালীন ঘরে কিংবা নিজস্ব কাজে যাওয়া জায়েয নেই। বরং তাকে কর্মস্থলে থাকতে হবে, যদিও সেবাপ্রার্থীর সংখ্যা কম থাকুক। কারণ অফিস টাইমের মালিক অফিস; সে নয়। সে যে বেতন নিচ্ছে অফিস ঐ বেতনের বিনিময়ে তার কাছ থেকে এই সময় ক্রয় করে নিয়েছে। তাই ব্যক্তিগত স্বার্থে এই প্রাপ্য সময়ে কোনো ঘাটতি করা জায়েয নয়। তবে চাকুরির নিয়মকানুন স্বীকৃত কোন ওজর থাকলে সেটা ভিন্ন কথা।’[সমাপ্ত]

৫- শাইখ ইবনে জিবরীন হাফিযাহুল্লাহকে জিজ্ঞেস করা হয়:

কোনো কর্মচারীর জন্য 'কাজ নেই' এই যুক্তি দিয়ে নিয়মিত কর্মস্থল ত্যাগ করা কি বৈধ? যদিও সে যে কাজটি করে সে কাজের তুলনায় তার বেতন অনেক বড়?

তিনি উত্তর দেন: অফিস টাইম শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো কর্মচারী তার কর্মস্থল ত্যাগ করবে না; এমনকি যদি সে কর্মহীন বসে থাকে তবুও। চাই তার বেতন বেশি হোক কিংবা কম হোক। কিন্তু যদি আকস্মিক কিছু ঘটে কিংবা তার এমন কিছু হয় যে সে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়; যেমন: অসুস্থতা বা জরুরী কোন কাজ এবং তার জন্য বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় না থাকে, তাহলে সে বের হতে পারে। কাজ সেরেই সে ফিরে আসবে। কারণ তার এই সময়ের মালিক রাষ্ট্র অথবা সে যেই কোম্পানির অধীনে কাজ করে ঐ কোম্পানি। তবে যদি তার কাজের ক্ষেত্র নির্ধারিত থাকে, তাহলে সে নির্ধারিত কাজটা শেষ করে যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারবে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।[সমাপ্ত][ফাতাওয়া মুহিম্মা লি-মুওয়ায্‌যাফিল উম্মাহ]

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

সূত্র

সূত্র

ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

at email

নিউজলেটার

ওয়েবসাইটের ইমেইল ভিত্তিক নিউজলেটারে সাবস্ক্রাইব করুন

phone

ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব অ্যাপ্লিকেশন

কন্টেন্টে আরও দ্রুত পৌঁছতে ও ইন্টারনেট ছাড়া ব্রাউজ করতে

download iosdownload android