এক:
কিছু চাকুরি আছে যেগুলো সত্তাগতভাবে হারাম। যেমন: সুদী ব্যাংকে চাকুরি করা কিংবা মদ বিক্রির দোকানে চাকুরি করা।
আর কিছু চাকুরি আছে যেগুলোর কর্মক্ষেত্রে বিদ্যমান শরীয়তের বিধান লঙ্ঘনের কারণে সে কাজগুলো হারাম। যেমন: নারী-পুরুষের মাঝে অবাধ মেলামেশা কিংবা হারাম পোশাক পরা অথবা শরীয়ত লঙ্ঘিত হয় এমন রূপ ধারণ করার শর্ত থাকা, যেমন: দাড়ি কামিয়ে ফেলা। এই উভয় প্রকার চাকুরিই মুসলিমের জন্য জায়েয নেই।
দ্বিতীয় প্রকারের চাকুরিগুলোর মাঝে হারামের মাত্রার তারতম্য আছে। সবচেয়ে বেশি পাপ এমন চাকুরিতে যেখানে সুদ লিখতে হয়। তারপর যেখানে হারাম কিছু বিক্রি বা নির্মাণ করতে হয়। তারপর এমন চাকুরি যার পরিবেশ হারাম। শেষোক্ত প্রকারের ব্যাপারেও অবহেলা করা যাবে না। কারণ এটি কর্মকর্তার দ্বীনদারিতা ও চালচলনে প্রভাব ফেলে। বিশেষতঃ নারীর ফিতনার ক্ষেত্রে; যা বনী ইসরাইলের প্রথম ফিতনা। এটি মুসলিম পুরুষের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর ফিতনা যেমনটি আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে জানিয়েছেন।
আপনাদের দেশে যদি সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মেলামেশা থাকে, নারী-পুরুষের মেলামেশা বিহীন না থাকার মত এবং আপনি যদি মনে করেন যে ঐ সমস্ত স্থানে আপনার উপস্থিতি উপকারী, আপনি কিছু অনিষ্ট দূর করতে পারবেন কিংবা কিছুটা হ্রাস করতে পারবেন, আপনার অধীনে থাকা কর্মচারীদেরকে উপদেশ দিতে পারবেন, তাদেরকে আপনার সাধ্যমত সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করতে পারবেন এবং নারীদের ফিতনা থেকে আপনাকে মুক্ত রাখবে এমন সতর্কতামূলক পদক্ষেপ আপনি গ্রহণ করবেন, যেমন: আপনি অবিবাহিত হলে দ্রুত বিবাহ করা, তাদের দিকে দৃষ্টিপাত না করা, তাদের সাথে একান্তে না থাকা, কর্মের প্রয়োজনে কিছু নারী সহকর্মীর সাথে বসলে অফিসের দরজা খোলা রাখা এবং নারী সহকর্মীর কাছাকাছি না বসা ইত্যাদি সেক্ষেত্রে আমরা মনে করি, যে চাকুরিতে থেকে আপনি কিছু শরয়ি কল্যাণ সাধন করতে পারবেন ও কিছু অনিষ্ট হ্রাস করতে পারবেন সেখানে আপনি থাকাটা এ চাকুরিগুলোতে একেবারে দ্বীনদার মানুষ না-থাকা ও অঙ্গনগুলো নিরেট বেদ্বীন ও শরয়ি বিধানের বালাই নেই এমন লোকদের জন্য ছেড়ে দেয়ার চেয়ে উত্তম। কারণ মাধ্যমে অনিষ্ট ব্যাপক আকার ধারণ করবে ও বাড়তে থাকবে এবং এর প্রতিকার করা কঠিন হয়ে যাবে। এমন কত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আছেন যারা সহশিক্ষা রয়েছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন, কিন্তু আল্লাহ তাদের মাধ্যমে অনেক উপকার সাধন করেছেন এবং বহু অনিষ্ট প্রতিহত করেছেন।
সুতরাং আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে আশা করছি যে, আপনিও ঐ সমস্ত সংস্কারকদের একজন হবেন।
তদুপরি, যদি আপনি মনে করেন যে, এ চাকুরিতে যোগদান করলে আপনি দ্বীনদারিতা রক্ষা করতে পারবেন না, বরং একটু একটু করে হারামের দিকে আপনাকে ধাবিত করা হবে, সেক্ষেত্রে আপনার সামনে তৎক্ষণাৎ চাকুরিটি ছেড়ে দেওয়া ছাড়া ভিন্ন কোনো উপায় নেই। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কোনো কিছু ছেড়ে দেয় আল্লাহ তাকে এর চেয়ে উত্তম কিছু প্রদান করেন; যেমনটি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন।
দুই:
সাহাবীরা যে সমস্ত কাজের মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন করেছেন তা অগণিত। তন্মধ্যে রয়েছে: ব্যবসা করা। যেমন: আবু বকর সিদ্দীক, উসমান ইবনে আফ্ফান, আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহুম। আরও রয়েছে: কৃষিকাজ করা; চাই তারা নিজেরা জমির মালিক হন কিংবা কর্মচারী হিসেবে খাটেন। এই ক্ষেত্র থেকে অনেক মুহাজির ও আনসার সাহাবী উপার্জন করতেন। আরও রয়েছে: পেশা-ভিত্তিক কাজ। যেমন: কামার, ছুতার ইত্যাদি। আরো রয়েছে রাষ্ট্রের সাথে জড়িত পেশা। যেমন: শিক্ষা, যাকাত সংগ্রহ, বিচার কাজ প্রভৃতি। আরো রয়েছে: জিহাদ থেকে উপার্জন; যেমন: গনীমত।
কিন্তু তৎকালীন জীবনযাত্রার ধরন, পেশা ও শিল্প এবং এ যামানায় জীবনযাত্রার ধরণ, পেশা ও শিল্পের মাঝে বিরাট ব্যবধান। "প্রত্যেক ঘটনার বক্তব্য আলাদা" যেমনটি প্রবাদে বলা হয়।
তিন:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাতের কর্মের উপর ব্যবসাকে প্রাধান্য দিয়েছেন মর্মে কোনো কথা আমাদের জানা মতে প্রমাণিত নয়। এ বিষয়ে আলেমদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ ব্যবসাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কেউ দিয়েছেন কৃষিকাজকে। আরেক দল হাতের কর্মকে প্রাধান্য দিয়েছেন। যেমন: হস্তশিল্প।
ব্যবসার ফযীলত প্রসঙ্গে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সেটি প্রমাণিত নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘রিযিকের দশ ভাগের নয় ভাগ ব্যবসায়।’[দেখুন: আস-সিলসিলাহ আদ-দঈফাহ: (৩৪০২)]
অন্যদিকে হাতের উপার্জন ও ব্যবসার ফযীলত প্রসঙ্গে বর্ণনা হচ্ছে: রাফে’ ইবনে খাদীজ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: জিজ্ঞাসা করা হলো: সর্বোত্তম উপার্জন কী? তিনি বললেন: “ব্যক্তির নিজ হাতের উপার্জন এবং প্রতিটি নির্ভেজাল বিক্রি।”[হাদীসটি আহমদ (১৭২৬৫) বর্ণনা করেন। মুসনাদের মুহাক্কিকরা এটিকে হাসান বলে গণ্য করেন। শাইখ আলবানী ‘সহীহুত তারগীব’ গ্রন্থে (১৬৯১) এটিকে সহিহ বলে গণ্য করেন]
মিকদাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “নিজের হাতের উপার্জন থেকে উত্তম খাবার কেউ কখনো খায়নি। আল্লাহর নবী দাউদ আলাইহিস সালাম নিজ হাতের উপার্জন থেকে খেতেন।”[বুখারী (১৯৬৬) হাদীসটি বর্ণনা করেন]
হাফেয ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘আলেমরা সর্বোত্তম উপার্জনের ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। মাওয়ার্দী বলেন: উপার্জনের মৌলিক মাধ্যম হচ্ছে: কৃষি, ব্যবসা ও পেশা। শাফেয়ীর মাযহাবে উত্তম উপার্জন হচ্ছে: ব্যবসা। তবে আমার কাছে অগ্রগণ্য হচ্ছে: সর্বোত্তম উপার্জন কৃষিকাজ। কারণ সেটি তাওয়াক্কুলের নিকটবর্তী।
ইমাম নববী পূর্বোক্ত মিকদাম (রাঃ) এর হাদীস দিয়ে তার বক্তব্যকে রদ করে বলেন: সঠিক হচ্ছে: সর্বোত্তম উপার্জন যা নিজের হাত দিয়ে যা করা হয়। যদি কেউ কৃষক হয় তাহলে এটি তার সর্বোত্তম উপার্জন। কারণ এতে রয়েছে নিজের হাতের কাজ। আর যেহেতু এতে তাওয়াক্কুল থাকে এবং এর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে মানুষ ও পশুর উপকার হয়। অধিকন্তু স্বভাবতঃই বিনিময় ছাড়া এর থেকে খাওয়া হয়।
আমি বলব: হাতের কামাইয়ে এর থেকেও উপরে রয়েছে জিহাদের মাধ্যমে কাফেরদের সম্পদ থেকে উপার্জন করা। এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীদের উপার্জন। এটি সবচেয়ে সম্মানজনক উপার্জন। কারণ এর মাধ্যমে আল্লাহর কালেমা উচ্চকিত হয় এবং তার শত্রুদের কালেমা লাঞ্ছিত হয়। এছাড়া এর দ্বারা আখিরাতের উপকার সাধিত হয়।
তিনি বলেন: যে ব্যক্তি নিজ হাতে কাজ করে না তার জন্য কৃষিকাজ উত্তম। এর কারণ আমরা ইতঃপূর্বে উল্লেখ করেছি।
আমি বলব: এর কারণ হলো ইতিপূর্বে যা উল্লেখ করা হয়েছে যে, এতে পরোপকার রয়েছে। বস্তুতঃ পরোপকার কেবল কৃষিকাজে সীমিত নয়। বরং যা কিছুতে হাত দ্বারা কাজ করা হয় তা সবই পরের উপকার করে। কারণ এর মাধ্যমে এমন কিছু প্রস্তুত করা হয় যা মানুষের প্রয়োজন।
সঠিক কথা হলো: এগুলোর স্তর বিভিন্ন। অবস্থা ও ব্যক্তিভেদে তা বিভিন্ন। আল্লাহ তাআলার কাছে এ বিষয়ের প্রকৃত জ্ঞান রয়েছে।’[সমাপ্ত][ফাতহুল বারী (৪/৩০৪)]
পূর্বোক্ত আলোচনার আলোকে যে ব্যক্তি অন্যান্য কাজের তুলনায় কৃষিকাজে দক্ষ তার জন্য কৃষিকাজ উত্তম। আবার পেশা-ভিত্তিক কাজ অন্য কারো জন্য উত্তম। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি যদি ব্যবসায় পারদর্শী হয় তাহলে তার জন্য ব্যবসা অন্য কিছু থেকে উত্তম।
তাই প্রত্যেক মানুষের উচিত নিজের সাথে মানানসই এবং নিজে দক্ষ এমন কাজ বাছাই করা। তারপর এই কাজের মাধ্যমে সে নিজে সকল মুসলিমের উপকার করার চেষ্টা করা উচিত। আল্লাহ তা’আলাই তৌফিকদাতা।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।