মঙ্গলবার 7 শাওয়াল 1445 - 16 এপ্রিল 2024
বাংলা

যে অবস্থাগুলোতে কিবলামুখী হওয়ার শর্ত মওকুফ হয়

প্রশ্ন

যে অবস্থাগুলোতে কিবলামুখী হওয়ার শর্ত মওকুফ হয়

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

সম্ভবতঃ প্রশ্নকারী ভাই সে অবস্থাগুলো জানতে চাচ্ছেন যে সব ক্ষেত্রে নামাযে কিবলামুখী হওয়ার শর্ত মওকুফ হয় এবং কিবলামুখী না হলেও নামায শুদ্ধ হয়।

নামায শুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলির মধ্যে রয়েছে: কিবলামুখী হওয়া। কিবলামুখী হওয়া ব্যতীত নামায শুদ্ধ হয় না। কেননা আল্লাহ্‌ তাআলা কুরআনে সে নির্দেশ দিয়েছেন এবং সে নির্দেশের পুনরাবৃত্তি করেছেন। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “তুমি যেখান থেকেই বের হও না কেন মসজিদে হারামের দিকে মুখ ফিরাও; আর তোমরাও যেখানেই থাক না কেন, এই মসজিদের দিকেই মুখ ফিরাও।”[সূরা বাক্বারা, ২:১৫০]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম যখন মদিনাতে এলেন তখন বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামায আদায় করতেন, কাবাকে তাঁর পিঠের দিকে এবং শামকে (সিরিয়াকে) তাঁর সামনের দিকে রাখতেন। কিন্তু এরপরে তিনি অপেক্ষা করছিলেন যে, আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁর জন্য এর বিপরীতটা করার বিধান নাযিল করবেন। সে কারণে তিনি আকাশের পানে বারবার মুখ ফেরাতেন কখন জিব্রাইল (আঃ) কাবার দিকে মুখ ফেরানোর ওহি নিয়ে নাযিল হবে। যেমনটি আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “আমি আপনাকে বারবার আকাশের দিকে তাকাতে দেখি। তাই অবশ্যই আমি আপনাকে আপনার পছন্দের এক কিবলার দিকে ফেরাব। আপনি মসজিদে হারামের দিকে আপনার মুখ ফিরান।”[সূরা বাক্বারা, ২:১৪৪]

এভাবে আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁর নবীকে মসজিদে হারামের দিকে মুখ ফিরানোর নির্দেশ দিয়েছেন; তবে তিনটি মাসয়ালায় এর ব্যতিক্রম হবে:

১। যদি কেউ অক্ষম হয়। যেমন অসুস্থ ব্যক্তি যার চেহারা কিবলার দিকে নয় এবং যার পক্ষে কিবলামুখী হওয়া সম্ভবপর নয়। এমতাবস্থায় তার কিবলামুখী হওয়ার বিধান মওকুফ হবে। দলিল হচ্ছে আল্লাহ্‌র বাণী: “অতএব যতটা পার আল্লাহ্‌কে ভয় কর।”[সূরা তাগাবুন, ৬৪:১৬] এবং আল্লাহ্‌র বাণী: “আল্লাহ্‌ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে দায়িত্ব আরোপ করেন না।”[সূরা বাক্বারা, ২:২৮৬] এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “যদি আমি তোমাদেরকে কোন আদেশ করি তাহলে সাধ্যানুযায়ী সেটা পালন কর।”[সহিহ বুখারী (৭২৮৮) ও সহিহ মুসলিম (১৩৩৭)]

২। যদি কেউ তীব্র ভয়ের মধ্যে থাকে। যেমন— কোন মানুষ তার শত্রু থেকে পালাতে থাকে, কিংবা কোন হিংস্র প্রাণী থেকে পালাতে থাকে, কিংবা বন্যার পানি থেকে পালাতে থাকে। এক্ষেত্রে যে দিকে তার চেহারা থাকে সে দিকে ফিরে নামায পড়বে। দলিল হচ্ছে আল্লাহ্‌র বাণী: “আর যদি তোমাদের ভয় থাকে তাহলে হাঁটতে হাঁটতে অথবা আরোহী অবস্থায় (নামায আদায় করবে)। অতঃপর যখন তোমরা নিরাপদ হবে তখন আল্লাহ্‌কে সেভাবেই যিকির (স্মরণ) করবে যেভাবে তিনি তোমাদের শিখিয়েছেন, যা তোমরা (আগে) জানতে না।”[সূরা বাক্বারা, ২:২৩৯]

আল্লাহ্‌র বাণী: “তোমাদের ভয় থাকে” যে কোন ধরণের ভয়কে শামিল করে এবং তাঁর বাণী: “অতঃপর যখন তোমরা নিরাপদ হবে তখন আল্লাহ্‌কে সেভাবেই যিকির (স্মরণ) করবে যেভাবে তিনি তোমাদের শিখিয়েছেন, যা তোমরা (আগে) জানতে না।”  প্রমাণ করে যে, মানুষ ভয়বশতঃ কোন ধরণের যিকির বর্জন করলে তাতে কোন অসুবিধা নেই। কিবলামুখী হওয়াটাও যিকিরের অন্তর্ভুক্ত।

ইতিপূর্বে উল্লেখিত আয়াতদ্বয় ও হাদিসও প্রমাণ করে যে, যে কোন আমল ওয়াজিব হওয়াটা সামর্থ্যের সাথে সম্পৃক্ত।

৩। সফর অবস্থায় নফল নামাযের ক্ষেত্রে; সেটা বিমানে হোক কিংবা গাড়ীতে হোক কিংবা উটের পিঠে হোক; এক্ষেত্রে তার চেহারা যে দিকেই থাকুক না কেন; যেমন- বিতিরের নামায, কিয়ামুল লাইল ও ইশরাকের নামায ইত্যাদি।

মুকীম ব্যক্তির মত মুসাফিরেরও উচিত সকল নফল নামায আদায় করা; কেবল যোহর, মাগরিব ও এশার সুন্নত নামাযগুলো ব্যতীত। কারণ সফরে এ নামাযগুলো না-পড়াই সুন্নত। মুসাফির যখন চলন্ত অবস্থায় নফল নামায পড়তে চাইবেন তখন তার চেহারা যে দিকেই হোক না কেন তিনি নামায পড়তে পারবেন। সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এটাই সাব্যস্ত আছে।

এ তিনটি মাসয়ালার ক্ষেত্রে কিবলামুখী হওয়া ওয়াজিব নয়।

পক্ষান্তরে, কেউ কিবলার দিক না জানলেও তার উপর কিবলামুখী হওয়া ওয়াজিব। তিনি যদি কিবলার দিক নির্দিষ্ট করার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করেন এবং চেষ্টাপ্রচেষ্টা সত্ত্বেও পরবর্তীতে যদি তার ভুল প্রমাণিত হয় তাহলে তাকে সে নামায পুনরায় পড়তে হবে না। তবে, তার ক্ষেত্রে আমরা এ কথা বলব না যে, তার উপর কিবলামুখী হওয়া মওকুফ করা হয়েছে। বরং তার উপরেও কিবলামুখী হওয়া ওয়াজিব এবং সে তার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করবে। সে যদি তার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করার পর তার ভুল ধরা পড়ে তাহলে সে নামায পুনরায় পড়তে হবে না। এর দলিল হচ্ছে সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে যারা কিবলা পরিবর্তনের খবর পায়নি তারা একদিন ক্বুবা মসজিদে ফজরের নামায পড়ছিলেন। এমন সময় এক লোক এসে বলল: আজ রাতে রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর কুরআন নাযিল হয়েছে এবং তাঁকে কাবামুখী হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতএব, তোমরা কাবার দিকে ফিরে যাও। সে সময় তাদের মুখ ছিল শামের দিকে। তখন তারা কাবার দিকে ঘুরে গেলেন।[সহিহ বুখারী (৪০৩) ও সহিহ মুসলিম (৫২৬)] কাবা শরীফ ছিল তাদের পেছনের দিকে। তারা নামায অব্যাহত রেখে ঘুরে গেলেন এবং কাবাকে তাদের সামনে করলেন। এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যামানায় ঘটেছে; কিন্তু এ আমলের কোন সমালোচনা করা হয়নি। অতএব, এটি শরিয়তঅনুমোদিত। অর্থাৎ কোন মানুষ যদি কিবলা চিনতে ভুল করে তাহলে সে নামায পুনরায় আদায় করা তার উপর ওয়াজিব নয়। কিন্তু যদি নামাযের মধ্যে তার ভুল প্রমাণিত হয় তাহলে তখনই কিবলামুখী হওয়া তার উপর ওয়াজিব।

কিবলামুখী হওয়া নামাযের একটি শর্ত। এ শর্ত পূরণ করা ছাড়া নামায শুদ্ধ হবে না। পূর্বোল্লিখিত তিনটি স্থান ব্যতীত। কিংবা কোন মানুষ যদি জানার চেষ্টা-প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ভুল করে।[সমাপ্ত]

"মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে উছাইমীন" (১২/৪৩৩-৪৩৫)

আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব